April 20, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

চম্বল: গোলকধাঁধা রহস্যে ফস্কে গেল মালখান সিং (পর্ব-৫)

[kodex_post_like_buttons]
বন্দুক ওই অঞ্চলের স্টেটাস সিম্বল। পৌরুষের প্রদর্শন। এই উপত্যকায় প্রায় প্রতি উচ্চবর্নের বাড়িতে দু তিনটে করে বন্দুক আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল সারাইয়ের দোকানের মতো বন্দুক সারাইয়ের ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ দেখেছি… সেরকমই কিছু দেখা নিয়ে শুরু  ‘চম্বল কাহিনী’।

সৌগত রায় রায় বর্মন 

সকালের ফার্স্ট বাসে ফিরে এলাম রছেড়। ফিরে এলাম যত সহজে বোললাম, ঘটনাটা তত সহজে ঘটেনি। মুরেনায় বাস থেকে নেমে দেখি, ব্যাগ ফেলে এসেছি বাসে। বাস চলে গেছে গুমটিতে। চাকা পাল্টাতে। কত দূর? প্রায় ৫ কিমি পথ। আমাদের মাথায় হাত। প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ি আর কী। আমাদের অবস্থা দেখে আশেপাশের লোকজন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ভাইয়া ইয়ে কলকাত্তা নেহি হ্যায়, ইয়ে চম্বল ঘাঁটি। এহাপে বাগী লোগ রহতে হ্যায়, চোর নেহি। ওই বাসটাই ঘন্টা বাদেক-বাদে ফিরে আসবে। রছেড় যাবে। তোমাদের ব্যাগ কেউ ছুঁয়েও দেখবে না। এ কথা শোনার পর সত্যিই বেশ লজ্জা পেলাম।

শীতের দুপুরে আদা, লবঙ্গ, এলাচের চা খেয়ে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল।
ঠিক ১ ঘন্টা বাদে বাস ফিরে এল। আমরা লাফিয়ে উঠলাম। ওই তো ব্যাগ। কে যেন যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে ড্রাইভারের পাশে। খুব লজ্জা করতে লাগল। আশঙ্কার কোনো কারণই ছিল না। কেন যে শহুরে মন এত সন্দেহগ্রস্থ, তা সেদিন যেমন বুঝিনি, আজও বুঝে উঠতে পারিনি।
বাস ছাড়ল। তখন বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। মাঝের এই ফ্যাকরাটা না ঘটলে, বিকেল বিকেল রছেড় পৌঁছে যেতে পারতাম। কিন্তু তা হবে না। গন্তব্যে পৌঁছতে-পৌঁছতে রাত ৮ টা বেজে যাবে। একে শীতের রাত, নিশুতি, তার উপর অচেনা চম্বল। অন্ধকারে বিস্তির্ণ গম খেত পেড়িয়ে আমরা গ্রামে পৌঁছবো কি করে? যদি ভুল করে বেহড়ে ঢুকে পরি? সর্বনাশ ।
আমাদের আন্দাজ ঠিকই ছিল। রাত ৮ টার একটু পরেই আমরা পৌঁছলাম রছেড়ের নির্দিষ্ট স্টপেজে। নেমেই সপাট থাপ্পড় খেলাম। ঠান্ডার। ভাগ্যিশ মাঙ্কি ক্যাপ সঙ্গে ছিল। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছি না যে। নিকশ কালো অন্ধকারে মাথার উপর অনন্ত নিহারীকা পুঞ্জের অগুন্তি হীরক খন্ড। চাঁদ নেই। তারার আলোয় পথ চিনবো, আমরা তেমন নাবিক নই।
মৃদুলাদা যেন দিগভ্রান্ত নৌ সেনাপতি। এই কঠিন সময়ে সিদ্ধান্ত যদি নিতেই হয় তবে আমরা দুজনে মিলেই নেব।
আমরা এসেছি মুরেনার দিক থেকে। বাস রাস্তার বাঁদিকে পড়েছিল রছেড় গ্রাম। সুতরাং বাঁদিকেই পড়বে। এটা নিশ্চিত। কিন্তু গ্রামটা চিনবো কি করে?
কিচুক্ষণ পরেই তারার আলোয় চোখ একটু একটু করে সয়ে গেল। আদিগন্ত গমের খেতটা পেড়িয়ে যেতে হবে। আলপথ ধরেই এগোতে হবে। কিন্তু কোনদিকে? মৃদুলদা বলে উঠল, নাক বরাবরই যাওয়া ভালো। দুরের ওই বড় তারাটার দিকে লক্ষ রাখ। ওটার দিকেই এগোব আমরা।
তাই ঠিক হল। আমরা দুই বঙ্গবীরপুংগপ কলম্বাসের মতো ভুল লক্ষে স্থির থেকে স্থলপথে যাত্রা শুরু করলাম।
আমাদের সঙ্গে টর্চ লাইটও নেই। আবছায়া তারার আলোয় হাঁটছি তো হাঁটছি। গ্রামের কোনো চিহ্নই নেই। ঘাড়ে ভারী লাগেজ নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। হাঁপাচ্ছিলাম। মাথা থেকে মাঙ্কিক্যাপ খুলে ফেললাম। ঠন্ডা হাওয়ার বেত্রাঘাতে মাথায় বেশ আরাম লাগতে লাগল। কিন্তু এতক্ষণে তো গ্রাম পৌঁছে যাওয়ার কথা। অন্তত আশপাশের কোনো গ্রামে তো বটেই। কিন্তু চোখের সামনে কেবল অন্ধকার। তা বলে তো দাঁড়িয়ে গেলে হবে না। হেঁটে যেতে হবে, যে দিকেই যাই না কেন! ঠিক কতক্ষণ হেঁটেছি তা আর মনে নেই। জ্ঞান হারানোর ঠিক আগের মুহূর্তে দূরে যেন ফস করে একটা আলো জ্বলে উঠল। প্রবল আনন্দে মৃদুলদাকে জড়িয়ে ধরলাম। ইঊরেকা! আলো দেখা গেছে। আমাদের চলার পথের ঠিক বাঁদিকে। মৃদুলদা সংশয়ের গলায় বলে উঠল, উহুঁ ওটা রছেড়ের আলো নয়। রছেড়ে আমরা বাস স্টপ থেকে নাক বরাবর সোজা গেছিলাম। 
ধুত্তোর নেভিগেশন, আমি বেশ রেগেই গেলাম। বললাম, এই অন্ধকারে রছেড় আর পাওয়া যাবে না। আলো যেদিক থেকে আসছে সেদিকেই যাবো। নিশ্চই কোনো না কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে।
আমরা আলোর দিকে ধাবোমান হলাম।
বেশ কিচুক্ষণ চলার পর দপ করে আলো নিভে গেল। আমরা দাঁড়িয়ে পরলাম। এটা কি হল? এবার উপায়? সর্বাঙ্গে ঘাম, তার উপর ঠান্ডা হাওয়ার চড়চাপাটি খেয়ে কিমকর্তব্যবিমুড় অবস্থা আমাদের।
হঠাৎই আগের আলোর ঠিক বিপিরীতে ফস করে আরো একবার আলো জ্বলে উঠল। আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো, আলেয়া। মৃদুলদা আমার দিকে ফিরে বলে উঠল, ঠিক বলেছিস! আমরা ভাগ্যবান রে, আলেয়া দেখলাম। সবার ভাগ্যে থাকে না। মৃদুলদার কবিসুলভ দর্শনে তখন আমার মন নেই। শুধু ভাবছি অত:কিম?
ঠিক হল যেদিকে যাচ্ছিলাম, সেদিকেই যাবো। যা হোক তা হোক। ক্লান্তির শেয সীমায় পৌঁছে হঠাৎই মনে হল বহুদুরে একটা আলো দেখতে পাচ্ছি। প্রথমে মনে হয়েছিল আবার আলেয়া। কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, না আগুন নয়, এক বিন্দু আলো। এবং আলোটা দুলছে। তার মানে?  তার মানে? হতে পারে হ্যারিকেন। মানে নিশ্চই কোনো গ্রাম। আমরা আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। গতি বেড়ে গেল দ্বিগুন। প্রায় দৌড়ে পৌঁছে গেলাম আলোর উৎসে। একটা গাছের ডালে কেউ হ্যারিকেন টাঙিয়ে গেছে! হয়তো প্রাকৃতিক কাজে। সুতরাং অপেক্ষা করাই উচিত মনে করে গাছের নীচে বসে পড়লাম।
সঙ্গে-সঙ্গে বুঝতে পারলাম কতটা ক্লান্তি আমাদের গ্রাস করেছে। ধীরে ধীরে তন্দ্রার কোলে ঢুকে পড়লাম। বেশীক্ষণ নয়। আধঘন্টা বাদে শীতের কাঁপুনিতে ঘুমের ঘোর কেটে গেল। হ্যারিকেনেটা দেখলাম সেই জায়গাতেই আছে। এবার সত্যিই ভয় পেলাম। ভৌতিক ? আধা ভৌতিক ? দৃষ্টিবিভ্রম? হ্যালুসিনেশন? গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম, না সেন্সে আছি। তবে উপায়? একটাই পথ। চেঁচানো। প্রাণপনে। শুরু করলাম চিৎকার- রতন ভাই, মোহর চাচা,  সুখরাম, হামলোগ কলকাত্তা সে আয়া। রছেড় কা মেহমান। আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি
শুধু চেঁচানোই সাড়। কোথাও কোনো উত্তর নেই। এই প্রবল শীতের রাতে নিশ্চয় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে সবাই। শুনতে পাচ্ছে না।
এত ডাকাডাকিতেও যখন কেউ সাড়া দিল না, তখন বুঝলাম ব্যাপারটা ভয়ের এবং সন্দেহজনক। পালানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। দু’জনে লাগালাম এক সঙ্গে ছুট। কেন যাচ্ছি,  কোথায় যাচ্ছি জানি না। আমরা ছুটছি আলোর দিকে নয়, আলোর বিপরীতে। একটু দাঁড়াই, হাঁপাই, আবার দৌড়াই । মিনিট পনেরো এইভাবে পালানোর পর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সেই একই আলো। সেই হ্যারিকেন। দুলছে। আবার ছুট… ছুট…। উল্টোদিকে। একই ভাবে আবার ছুট। কিন্তু এ কী গোলকধাঁধাঁ। আবার আলো। সেই হ্যারিকেন। দুলছে আস্তে আস্তে। 
একই ঘটনা ঘটল আরো দুবার। এক সলতে আলোর কাছে বারবার ফিরে ফিরে আসা। এক সময় ক্লান্তির শেয সীমায় এসে আমরা আর পারলাম না। ভাঙা মাটির বুকে বসে পড়লাম। সকালের আগে আর কিছু করার নেই। হয় মৃত না হয় অর্ধমৃত অবস্থায়, কেউ না কেউ আমাদের খুঁজে পাবে। “ভূতে”র হাত থেকে বাঁচার একটাই পথ, ঘুমানো।
পরের দিন ঘুম ভাঙলো লোকজনের চেঁচামেচিতে। আমাদের প্রায় কোঁচকানো অবস্থায় শোয়ানো হয়েছে কোনো এক গ্রামের মাঠে। চড়া রোদে শুইয়ে আমাদের গরম দুধ খাইয়েছে গ্রামের লোক। চামচ দিয়ে। একটু একটু করে। ফলে মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে আমরা আবার কেমন করে জানি ফিরে এলাম চম্বলের মাটিতে।
এই কদিনের মধ্যে আশেপাশের গ্রামগুলিতে আমাদের একটা পরিচিতি হয়ে গেছিল। পত্রকার। কলকাত্তা সে আয়া। ফলে আমাদের দেখেই ওরা চিনতে পেরেছিল। একটু সুস্থ হয়ে যা শুনলাম তা বুদ্ধুভুতুমের চাইতেও অলীক রূপকথা।
 রছেড় থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে সুলতানগঞ্জের বেহড়ে আমাদের প্রায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছিল। এই ১৫ কিমি পথ আমরা বেহড়ের মধ্যে দিয়ে এসেছি। নিজেদের অজান্তেই। শুয়েছিলাম একটা কুলঝোপের পাশে। সকালে ছাগল চড়াতে এসে এক রাখাল ছেলে আমাদের উদ্ধার করে। সেইই পাশের গ্রাম সুলতানগঞ্জে খবর দেয়। ওখানকার মানুয আমাদের জমে যাওয়া বডি তুলে আনে গ্রামে। আগুন জ্বালিয়ে,  রোদে ভেজে গরম দুধ খাইয়ে ওরা আমাদের পরলোক যাত্রা স্থগিত করে দিয়েছিল।
কিন্তু গোলকধাঁধা? গল্পে শুনেছিলাম, কিন্তু আমরা তো নিজেই তার শিকার হয়েছি। তবে? এনার্জি ফিল্ড? হতেও পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পন্ডিতরা বলতে পারবেন রহস্যটা কি?
আর হ্যারিকেন? এ প্রসঙ্গটা উঠলেই ওরা যেন কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে। কেন? ভূতের ভয়ে? 
পরে রছেড় পৌঁছে রতনকে জিজ্ঞাসা করায় সে হাসতে হাসতে জবাব দিল, ওটা সিগনাল। মালখান সিং এর  দল ওখান থেকে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে সাবধানি দিচ্ছিল, আপনারা পুলিশ হতে পারেন। খুব বাঁচা বেচে গেছেন দাদা। মালখানের দলের হাতে ওই অবস্থায় পড়লে, খুব মুশকিলে পড়তে হত আপনাদের। গ্রাম সুদ্ধ লোক কে সাক্ষী দিতে হত যে আপনারা পুলিশ নন। আমাদের মেহমান।
আমি আর মৃদুলদা চোখে চোখে কথা সেরে নিলাম, মনে মনে ভাবলাম, একটা চান্স মিস হয়ে গেল।
মালখানের সঙ্গে অবশ্য দেখা হয়েছিল, ফুলনের সঙ্গে একই জেলে। সে কথা এখন নয়, পরে বলা যাবে। 
(ক্রমশ)

Related Posts

Leave a Reply