চার দশক পর ফেসবুক থেকে দাদার খুনিকে খুঁজে বের করলেন সাংবাদিক বোন!
কলকাতা টাইমসঃ
৪০ বছর আগে গুয়াতেমালায় নৃশংস ভাবে খুন করা হয় এক প্রেমিক-প্রেমিকাকে। তাদের মৃতদেহগুলো ভাসিয়ে দেওয়া হয় ক্যারিবিয়ান সাগরে। সেই হত্যাকাণ্ডের ৪ দশক পর খুনীকে ধরার তৎপরতা স্বাভাবিকভাবেই না থাকার কথা। কিন্তু এত দিন পর সেই খুনীকে ধরা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাধ্যম থেকে। ইন্টারনেটে যেকোনো কিছুই মেলে। স্কুলের বন্ধু, অচেনা আত্মীয় কিংবা পরিচিত প্রিয়জন- সবাইকে খুঁজে বের করা যায় ইন্টারনেট থেকে। তারা যদি সেখানে নাও থাকেন, তবে ইন্টারনেটেই এমন কেউ আছেন যিনি তাদের ঠিকানা বলতে পারেন। এটা সোশাল মিডিয়ার যুগ। লুকিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
২০১৫ সালের ২ অক্টোবর। পেনি ফারমার হাঁটতে বেরিয়েছিলেন অক্সফোর্ডশায়ারের শহরতলী এলাকায়। বাড়ি ফিরেই ল্যাপটপ খুলে ফেসবুকে বসলেন। তার দাদার খুনী হিসেবে একজনকে সন্দেহ করেন তিনি। কিন্তু তার দেখা কোথাও মেলে না। আচমকা ফেসবুকেই পেয়ে গেলেন সন্দেহভাজন খুনীকে। ধূসর দাড়ি তার মুখে, মাথায় বেসবল ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস। পরনে ডেনিস শার্ট। একেবারে সিরিয়াল কিলারের মতো দেখতে। গায়ের রক্ত হিম হয়ে এলো পেনির। এখানে তাকে এতদিন কেন খোঁজেননি, আক্ষেপ করতে লাগলেন।
বিস্ময় ধরে রাখতে পারেন না পেনি। ১৯৭৮ সালে জুলাইয়ে পেনির দাদা ক্রিস এবং তার বান্ধবী পেটা ফ্রাম্পটনের মৃতদেহ গুয়াতেমালার উপকূলে ভাসতে দেখা যায়। তাদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ দেহে বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয় দেহগুলো। তখন ক্রিস ছিলেন ২৫ বছর বয়সী একজন তরুণ চিকিৎসক। আর পেটা ২৪ বছরের আইনজীবী। ছোটবেলা থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। পরে প্রেম।
তখন থেকেই তাদের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তদন্ত চালায় পুলিশ। পেটা বাড়িতে পাঠানো শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন, বেলিজে এক আমেরিকান এবং তার দুই ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের। আরো বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা ছিল তাদের। বেলিজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাস্টিন বি নামের একজনের সঙ্গে বোটে চড়ে ক্রিস এবং পেটা ঘুরতে যান। কিন্তু ফেরার পর তারা বোটে ছিলেন না। একা ফেরেন জাস্টিন। যে আমেরিকানের সঙ্গে পরিচয় ঘটার কথা তারা চিঠিতে জানান তার নাম সিলাস বোস্টন। তার খোঁজ মেলে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাকরামেন্তোতে। কিন্তু পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে ক্রিস আর পেটা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছুই বের করতে পারেনি।
এরপর ভাই এবং তার বান্ধবীকে হারানোর বিষাদময় সময় কাটে এই কৃষক পরিবারের। তবে আমেরিকার পুলিশ খুব বেশি সহায়ক ছিল না। দাদা যখন খুন হন, তখন পেনির বয়স মাত্র ১৭। পরে সাংবাদিক হয়েছেন। বিয়ে করে তিন সন্তানের জননীও হয়েছেন। সময়ের সঙ্গে তাদের জীবন ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। সাংবাদিকতাসুলভ মানসিকতার জন্যেই হোক, কিংবা দাদার খুনীকে খুঁজে বের করার দৃঢ় প্রত্যয়, পেনি কিন্তু খুনীর কথা ভুলতে পারেননি। তাকে খুঁজে বের করার প্রবণতা তার মধ্যে সব সময়ই ছিল।
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটে। পেনির বাবা পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। তার বাবা মারা যান ২০১৩ সালে। পেনি মাঝে মাঝে ফেসবুকে ঢুঁ মারতেন সেই খুনীকে খোঁজার আশায়। ২০১৬ সালে প্রাথমিকভাবে ফেসবুকে খুনীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন পেনি। এই তথ্য নিয়ে পেনি তার মা এবং বড় ভাই নাইজেলকে সঙ্গে করে গ্রেটার ম্যানচেস্টার পুলিশের সঙ্গে দেখা করেন। পুলিশ বোস্টনের সেই দুই ছেলের বক্তব্য শোনেন। কী ঘটেছিল তা পরিষ্কার হয়ে যায়। বোস্টন ছিলেন ধর্ষক। তার ভাইকে বেঁধে পেটাকে নিয়ে বোটের কেবিনে চলে যান। এর পর দুজনকেই হত্যা করা হয়। ক্রিসের খুলি ফাটা ছিল। হাড়ও ভাঙা হয়েছিল। বোটের ডেকে ছিল প্রচুর রক্ত।
শেষ পর্যন্ত খুনী বোস্টনের সন্ধান মেলে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইউরেকার একটি নার্সিং হোমে থাকেন। সেখানে থাকাকালীন বছর দুয়েক আগে বাড়তি কিছু আয়ের উদ্দেশ্যে ফেসবুকে একটি পেজ খুলেছিলেন তিনি। আর সেটাই কাল হলো তার কাছে। পরে এফবিআই বেলিজ এবং গুয়েতেমালা থেকে বেশ কয়েকজন সাক্ষীকে খুঁজে বের করে। এদের মধ্যে একজন অ্যাম্বুলেন্সের গার্ড হিসেবে চাকরি করতেন। তিনি ক্রিস এবং পেটার মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছিলেন। এখন নিউ ইয়র্কে থাকেন। যে চিকিৎসক মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করেছিলেন তাকেও পাওয়া গেছে।
রাসেলের সঙ্গে পরে দেখাও করেছেন পেনি। রাসেলকে দেখে অবাক হয়েছেন পেনি। এক মানসিক বিকারগ্রস্ত বাবার কাছে বড় হয়ে কীভাবে এত স্বাভাবিক থাকেন তিনি! আরো ভয়ংকর সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে বোস্টন বি’কে নিয়ে। রাসেলের বক্তব্যে উঠে এসেছে, তার বাবা ৩৩ জনকে হত্যা করেছেন। যদি তা সত্যি হয়, তবে আমেরিকান ইতিহাসে এই বোস্টন সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বুদ্ধিমান সিরিয়াল কিলার। এমনকি তিনি নাকি রাসেল এবং তার আরেক ভাইকে মেলে ফেলারও হুমকি দিয়েছিলেন।
ফেসবুকে খুনীকে খুঁজে পাওয়ার ১৪ মাস পর ২০১৭ সালে বোস্টনকে গ্রেপ্তার করা হয়। খুনের পর কেটে গেছে ৩৮ বছর। ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায় সিলাস বোস্টন। ফেসবুকের কল্যাণেই হারিয়ে যাওয়া খুনীকে শনাক্ত করে তাকে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন পেনি। খুনীর মৃত্যুর কারণে এই কেসেরও অবসান ঘটে।