‘সু-রা’ মানে মদ নয় ! সুকুমার রায় !!
[kodex_post_like_buttons]
জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ
রজত পাল
বলে ফেললাম বটে মদ নয়, তবে কবি-সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের নেশা তার চেয়েও বেশী। এ নেশার side effect গুলো যেমন positive , তেমনই সময়ের সাথে সাথে তার চড়চড়িয়ে তৃপ্তি। বাঙালি রসসাহিত্যে সুকুমার রায় হলেন চিরনবীন বীর আলেকজান্ডার, যিনি ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিদায় নিলেও প্রায় ১০০ বছর ধরে আমাদের কাছে ‘পুরানো মদ’-এর মতো। তার বহু কবিতার লাইন বাঙালিসমাজে প্রবাদে পরিণত হয়েছে। যেমন ধরুন না
– কেউ একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেই আমবা বলে দিই সে ‘রামগরুড়ের ছানা’।
– বারবার একই ভুল করলে আমরা বলি, ‘ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায়’ ?
– অথবা, ‘সখের প্রাণ গড়ের মাঠ’
– বা, ‘লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ’ ইত্যাদি
তার স্বনামধন্য পুত্র সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার কল্যাণে আমরা জানি ফেলুদা যেসব ছড়া আওড়ান, সেগুলি মূলতঃ সুকুমার রায়ের ( হলদে সবুজ ওরাং ওটাং বা মুশকিল আসান উড়ে মালি, ধর্মতলায় কর্মখালি; বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু, আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু ইত্যাদি)। আবোল তাবোল পড়েনি, হ-য-ব-র-ল -র নাম শোনেনি বা খাই খাই এর পদ্য পড়ে আহ্লাদিত হয়নি এমন বাঙালি কজন আছে ?
অনেকেই আবার এসব nonsense লেখাকে সাহিত্যের উপযোগী মনে করেন না। সুকুমার রায় নিজেও ‘আবোল তাবোল’ এর মুখবন্ধে ‘কৈফিয়ৎ’ দিয়েছেন,
‘ ইহা খেয়াল রসের বই…যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার’।
তা আজগুবি অসম্ভব লেখাই কি সহজ নাকি ? রবীন্দ্রনাথ অসম্ভব গল্প নিয়ে আলোচনায় বললেন, ‘হোক না অসম্ভব, তারও তো একটা বাঁধুনি থাকা চাই’।
এই বাঁধুনিটাই সুকুমার রায়ের সম্পদ। এইখানেই তিনি বাঙালি কেন, বিশ্বসাহিত্যের সেরাদের অন্যতম। যেমন দেখুন না,
‘ ঠোঙা ভরা বাদামভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না …’ এই যে রাজা ইঁটের পাঁজার ওপর বসে বাদাম চিবুচ্ছে, তার আসলে খাওয়ায় মন নেই। অথবা দেখুন ‘হুঁকো-মুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা…’ তে আমরা কখনই একটা মানুষের মুখ হুঁকোর মতন হয় কিনা তা খুব একটা ভাবিনা অথচ কবিতাটি ভালো লাগে। এই বাঁধুনি আলগা হয়ে গেলে কি হতে পারে তার উদাহরণও উনিই দিয়েছেন ‘চলচিত্ত চঞ্চরি’ তে ভবদুলালের গান দিয়ে, যাতে
‘ বলি ও হরিরামের খুড়ো –
তুই মরবি রে মরবি বুড়ো।’
এই গানে আবার টুইঙ্কল টুইঙ্কল এর সুর দিয়ে গাইলে কি হতে পারে সেটা ভেবে দেখুন একবার!
অথবা ‘ঝালাপালা’ নাটকে ইংরেজি কম জানা গুরুমশাই যখন ‘I go up, we go down’ এর বাংলা করলেন যে ‘গরুর চক্ষে জল ( আই = চোখ; গো = গরু, আপঃ = জল) কারন গোডাইনে উই লেগেছে’, তখন আমরা প্রথমে হেসে উঠি, তার পর ভাবতে বসি যে লেখকের এই ভাবনার পেছনে কি পরিমান রসবোধ ও মেধা লুকিয়ে আছে। আমাদের চারপাশে এরকম চরিত্র কি নেই নাকি ? শোনেননি বুঝি ( Man is mortal = মানুষ মাত্রই ভুল হয় !!)। অথবা ‘ঝালাপালা’-তে কেদারের লেখা কবিতা,
‘একদা সকালে আমি খাইতেছিলাম ভাত
হেনকালে ধেয়ে আসে প্রকান্ড এক ব্যাঘ্র…।।
আধুনিক কবিতার অথবা নীরস কাব্যপ্রচেষ্টার কি নিদারুণ উপমা।
লিয়র বা লুইস ক্যারল-এর কবিতার প্রভাব আছে অনেকেই বলেন। একথা যদি আমরা ধরেও নিই তবুও আমরা বিচার করব যে প্রায় একশ বছর ধরে আমরা সুকুমারে মাতোয়ারা হয়েছি কিনা ? এটাও মনে রাখব যে সুকুমার শুধুই কবি নন, তিনি অসাধারণ নাট্যকারও বটে। কে ভুলতে পারে চলচিত্ত চঞ্চরি, ঝালাপালা, অবাক জলপান, লক্ষ্মণের শক্তিশেল ইত্যাদি নাটক এবং তাতে থাকা অসাধারণ সব সংলাপ।
রামের কাছে দূত খবর এনেছে যে রাবণের বাহিনী আসছে এবং তাদের ‘ঢাক ঢোল বাজছে, ধ্যারারারারা……’। শুনে জাম্বুবান বলে উঠল ‘ যেন রেকারিং ডেসিমাল’। কিংবা, লক্ষ্মণের প্রাণ বাঁচানোর কৃতিত্ব যখন সবাই নিতে ব্যস্ত তখন লক্ষ্মণ বলে ওঠে যে সে শক্তিশেল খেল বলেই না এতো কিছু। এছাড়াও সোমপ্রকাশের অসাধারণ সংলাপ, ‘পরনিন্দা তো দূরের কথা, নিজের নিন্দাও সহ্য হয় না’।
এইসব সংলাপ তো শুধু হাসির উপাদান নয়, আমাদের সাধারণ মানুষের অগভীর চরিত্রের কি অপূর্ব ঝলক।
যারা না বুঝে পড়া মুখস্থ করা নিয়ে ‘3 Idiots’ -এর রসিকতা উপভোগ করেছিলেন তারা একবার ‘চলচিত্ত চঞ্চরি’-র গরুর সংজ্ঞাটি দেখে নিতে পারেন ।
তার অনবদ্য সব রচনার কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি । ‘নিঝুম নিশুতি রাতে, একা শুয়ে তেতলাতে, খালি খালি খিদে কেন পায় রে’? এ প্রশ্নের যেমন উত্তর পাই নি, তেমনি অনেক সাহস জোগান দিয়েও ভিতু বন্ধুকে ‘সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে এমন ভয় পেলে’ বলে দেখেছি বিপদ বেড়েছে । বয়স বাড়লে জ্ঞান দেবার প্রবণতা বেড়ে যায় । তার উদাহরণ ‘বুঝিয়ে বলা’ কবিতায় । তা শ্যামাদাস কেন, নবীন কেউই যে সেসব শুনতে চায় না, তার চেয়ে বড় সত্যি আর নেই, সে বুড়োর যতই ‘কান মলে দি পেঁচিয়ে’-র ইচ্ছে হোক না কেন ! তবে এই কবিতায় লাখ কথার এক কথা সে বুড়ো বলেছেন –
‘ বলছিলাম কি, বস্তু পিন্ড সূক্ষ্ম হতে স্থুলেতে
অর্থাৎ কিনা লাগছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে –
গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি করে
রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে ‘।
আহা ! আহাহা !!
কবি-লেখক ছাড়াও তার একজন সমাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন ভূমিকা ছিল তার প্রমাণ পাই প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশকে লেখা ১৯১৭ সালের এক পত্রে। বললেন,’আদর্শ বহনকারী সমাজ চাই’। রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথ স্থাপিত ব্রাহ্মসমাজ, যা বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের দিশা দেখিয়েছিল, তা সুকুমারের আমলে গতিহীন। ব্রাহ্মসমাজ ভেঙ্গে টুকরো হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে (ততদিনে উনি বিশ্ববিখ্যাত) সম্মানীয় সদস্য করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন ১৯১৬ সালে। তিনবছর বাদে রবীন্দ্রনাথ নির্বাচিত হলেন বটে, তবে ততদিনে সুকুমার কিছুটা অসুস্থ এবং মানসিকভাবে এসব থেকে অনেক দূরে। সময়ের আগে যারা ভেবে ফেলেন, তাদের এটাই নিয়তি। রবি ঠাকুর আজ আমাদের কাছে ‘ঠাকুর’ হয়েছেন বটে, তবে তাকেই বা কজন সঠিক বুঝেছিলেন সেইসময়। জালিওয়ানাবাগের হত্যার প্রতিবাদে দেশের রাজনৈচিত নেতাদের সমর্থন পাননি, ‘নাইটহুড’ ত্যাগ করে একাকী প্রতিবাদ করেছিলেন।
কি ভালোই না বাসতেন কবিগুরু সুকুমারকে। শয্যাশায়ী সুকুমারের বিছানায় মাথার পাশে বসে গান শুনিয়েছেন। তার প্রয়াণে শোক করেছেন। এমনকি প্ল্যানচেট এ ডেকেছেন সুকুমারকে ( এই প্ল্যানচেট বিষয়টি সত্যি-মিথ্যা যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ যে প্রশ্নগুলি করেছিলেন তার থেকেই বোঝা যায় এই মানুষটিকে কি গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং বয়সে ছোট হলেও সম্মান করতেন)।
পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘চৌধুরী’ উপাধি বর্জন করলেও তার চালু করা ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সাফল্যের সাথে পরিচালনা করছিলেন ১৯১৫ সাল থেকে। বিলেতের ‘রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’-র সদস্য ছিলেন। পুরস্কারও পেয়েছেন ছবি পাঠিয়ে। ছিলেন বিজ্ঞানের স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে বিলেত গেছিলেন কারিগরি শিক্ষার্থে । কালাজ্বরের ওষুধ আবিস্কৃত না হওয়ায় অকালে চলে গেলেন মাত্র ৩৬ বছ বয়সে। বুঝতে পারছিলেন থাকবেন না। তাই লিখলেন।
‘ আজকে দাদা যাবার আগে
বলব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই বা তাহার অর্থ হোক
নাই বা বুঝুক বেবাক লোক …।।
এই একটা ভুল করেছিলেন সেই মহামানব। বাঙালি তার লেখায় রস খুঁজে পেয়েছে, বেবাক লোকে তার লেখা বুঝেছে, যত দিন এগোচ্ছে তার নামে গড়ে উঠেছে ‘সুকুমার ক্লাব’। তার লেখা বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে। ক্রমশঃ তিনি এদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠছেন।
আমি আপনি ছোটবয়সে যে ছড়া লেখার মকশো করতাম, তা ভেবে লজ্জা পাবার কিছু নেই, কারণ স্বয়ং রবি ঠাকুর ‘ক্ষান্ত পিসির দিদি শাশুড়ির একজন থাকে কালনায়’ জাতীয় ছড়া লিখেছেন অনুপ্রাণিত হয়ে (‘খাপছাড়া’ প্রকাশ পায় সুকুমার দেহ রাখার তের বছর বাদে ) । কৈশোরের ডায়েরি ঘেটে এ অধমের একটি ছড়া তুলে দিচ্ছি এই সুযোগে । ৩০ শে সেপ্টেম্বর তার জন্মদিনে এটাই আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ঝকমকে দিনে ঠাসা চকমকে আলো
মেঘলার পরে তাই বেশ লাগে ভালো ।
চনমনে মন আজ আনমনা দিনে
ভুলে যাও ছিল কাল রাত ঘিনঘিনে ।
প্রাণ ভরে গান গাও, তাল দাও তাল
সাথে থাক দুনিয়ার বেবাক বেচাল ।
আমি বলি সে কেবল প্রকৃতির দোষ
খামোখা জগৎ জুড়ে কোপ ভরা রোষ ।
যত খাবে ভ্যাবাচ্যাকা, তত গাও গান
তুমি আমি সক্কলে সমান সমান ।।
– কেউ একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেই আমবা বলে দিই সে ‘রামগরুড়ের ছানা’।
– বারবার একই ভুল করলে আমরা বলি, ‘ন্যাড়া বেলতলায় কবার যায়’ ?
– অথবা, ‘সখের প্রাণ গড়ের মাঠ’
– বা, ‘লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ’ ইত্যাদি
তার স্বনামধন্য পুত্র সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার কল্যাণে আমরা জানি ফেলুদা যেসব ছড়া আওড়ান, সেগুলি মূলতঃ সুকুমার রায়ের ( হলদে সবুজ ওরাং ওটাং বা মুশকিল আসান উড়ে মালি, ধর্মতলায় কর্মখালি; বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু, আজকে রাতে দেখবি একটা মজারু ইত্যাদি)। আবোল তাবোল পড়েনি, হ-য-ব-র-ল -র নাম শোনেনি বা খাই খাই এর পদ্য পড়ে আহ্লাদিত হয়নি এমন বাঙালি কজন আছে ?
অনেকেই আবার এসব nonsense লেখাকে সাহিত্যের উপযোগী মনে করেন না। সুকুমার রায় নিজেও ‘আবোল তাবোল’ এর মুখবন্ধে ‘কৈফিয়ৎ’ দিয়েছেন,
‘ ইহা খেয়াল রসের বই…যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার’।
তা আজগুবি অসম্ভব লেখাই কি সহজ নাকি ? রবীন্দ্রনাথ অসম্ভব গল্প নিয়ে আলোচনায় বললেন, ‘হোক না অসম্ভব, তারও তো একটা বাঁধুনি থাকা চাই’।
এই বাঁধুনিটাই সুকুমার রায়ের সম্পদ। এইখানেই তিনি বাঙালি কেন, বিশ্বসাহিত্যের সেরাদের অন্যতম। যেমন দেখুন না,
‘ ঠোঙা ভরা বাদামভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না …’ এই যে রাজা ইঁটের পাঁজার ওপর বসে বাদাম চিবুচ্ছে, তার আসলে খাওয়ায় মন নেই। অথবা দেখুন ‘হুঁকো-মুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা…’ তে আমরা কখনই একটা মানুষের মুখ হুঁকোর মতন হয় কিনা তা খুব একটা ভাবিনা অথচ কবিতাটি ভালো লাগে। এই বাঁধুনি আলগা হয়ে গেলে কি হতে পারে তার উদাহরণও উনিই দিয়েছেন ‘চলচিত্ত চঞ্চরি’ তে ভবদুলালের গান দিয়ে, যাতে
‘ বলি ও হরিরামের খুড়ো –
তুই মরবি রে মরবি বুড়ো।’
এই গানে আবার টুইঙ্কল টুইঙ্কল এর সুর দিয়ে গাইলে কি হতে পারে সেটা ভেবে দেখুন একবার!
অথবা ‘ঝালাপালা’ নাটকে ইংরেজি কম জানা গুরুমশাই যখন ‘I go up, we go down’ এর বাংলা করলেন যে ‘গরুর চক্ষে জল ( আই = চোখ; গো = গরু, আপঃ = জল) কারন গোডাইনে উই লেগেছে’, তখন আমরা প্রথমে হেসে উঠি, তার পর ভাবতে বসি যে লেখকের এই ভাবনার পেছনে কি পরিমান রসবোধ ও মেধা লুকিয়ে আছে। আমাদের চারপাশে এরকম চরিত্র কি নেই নাকি ? শোনেননি বুঝি ( Man is mortal = মানুষ মাত্রই ভুল হয় !!)। অথবা ‘ঝালাপালা’-তে কেদারের লেখা কবিতা,
‘একদা সকালে আমি খাইতেছিলাম ভাত
হেনকালে ধেয়ে আসে প্রকান্ড এক ব্যাঘ্র…।।
আধুনিক কবিতার অথবা নীরস কাব্যপ্রচেষ্টার কি নিদারুণ উপমা।
লিয়র বা লুইস ক্যারল-এর কবিতার প্রভাব আছে অনেকেই বলেন। একথা যদি আমরা ধরেও নিই তবুও আমরা বিচার করব যে প্রায় একশ বছর ধরে আমরা সুকুমারে মাতোয়ারা হয়েছি কিনা ? এটাও মনে রাখব যে সুকুমার শুধুই কবি নন, তিনি অসাধারণ নাট্যকারও বটে। কে ভুলতে পারে চলচিত্ত চঞ্চরি, ঝালাপালা, অবাক জলপান, লক্ষ্মণের শক্তিশেল ইত্যাদি নাটক এবং তাতে থাকা অসাধারণ সব সংলাপ।
রামের কাছে দূত খবর এনেছে যে রাবণের বাহিনী আসছে এবং তাদের ‘ঢাক ঢোল বাজছে, ধ্যারারারারা……’। শুনে জাম্বুবান বলে উঠল ‘ যেন রেকারিং ডেসিমাল’। কিংবা, লক্ষ্মণের প্রাণ বাঁচানোর কৃতিত্ব যখন সবাই নিতে ব্যস্ত তখন লক্ষ্মণ বলে ওঠে যে সে শক্তিশেল খেল বলেই না এতো কিছু। এছাড়াও সোমপ্রকাশের অসাধারণ সংলাপ, ‘পরনিন্দা তো দূরের কথা, নিজের নিন্দাও সহ্য হয় না’।
এইসব সংলাপ তো শুধু হাসির উপাদান নয়, আমাদের সাধারণ মানুষের অগভীর চরিত্রের কি অপূর্ব ঝলক।
যারা না বুঝে পড়া মুখস্থ করা নিয়ে ‘3 Idiots’ -এর রসিকতা উপভোগ করেছিলেন তারা একবার ‘চলচিত্ত চঞ্চরি’-র গরুর সংজ্ঞাটি দেখে নিতে পারেন ।
তার অনবদ্য সব রচনার কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি । ‘নিঝুম নিশুতি রাতে, একা শুয়ে তেতলাতে, খালি খালি খিদে কেন পায় রে’? এ প্রশ্নের যেমন উত্তর পাই নি, তেমনি অনেক সাহস জোগান দিয়েও ভিতু বন্ধুকে ‘সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে এমন ভয় পেলে’ বলে দেখেছি বিপদ বেড়েছে । বয়স বাড়লে জ্ঞান দেবার প্রবণতা বেড়ে যায় । তার উদাহরণ ‘বুঝিয়ে বলা’ কবিতায় । তা শ্যামাদাস কেন, নবীন কেউই যে সেসব শুনতে চায় না, তার চেয়ে বড় সত্যি আর নেই, সে বুড়োর যতই ‘কান মলে দি পেঁচিয়ে’-র ইচ্ছে হোক না কেন ! তবে এই কবিতায় লাখ কথার এক কথা সে বুড়ো বলেছেন –
‘ বলছিলাম কি, বস্তু পিন্ড সূক্ষ্ম হতে স্থুলেতে
অর্থাৎ কিনা লাগছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে –
গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি করে
রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে ‘।
আহা ! আহাহা !!
কবি-লেখক ছাড়াও তার একজন সমাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন ভূমিকা ছিল তার প্রমাণ পাই প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশকে লেখা ১৯১৭ সালের এক পত্রে। বললেন,’আদর্শ বহনকারী সমাজ চাই’। রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথ স্থাপিত ব্রাহ্মসমাজ, যা বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের দিশা দেখিয়েছিল, তা সুকুমারের আমলে গতিহীন। ব্রাহ্মসমাজ ভেঙ্গে টুকরো হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে (ততদিনে উনি বিশ্ববিখ্যাত) সম্মানীয় সদস্য করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন ১৯১৬ সালে। তিনবছর বাদে রবীন্দ্রনাথ নির্বাচিত হলেন বটে, তবে ততদিনে সুকুমার কিছুটা অসুস্থ এবং মানসিকভাবে এসব থেকে অনেক দূরে। সময়ের আগে যারা ভেবে ফেলেন, তাদের এটাই নিয়তি। রবি ঠাকুর আজ আমাদের কাছে ‘ঠাকুর’ হয়েছেন বটে, তবে তাকেই বা কজন সঠিক বুঝেছিলেন সেইসময়। জালিওয়ানাবাগের হত্যার প্রতিবাদে দেশের রাজনৈচিত নেতাদের সমর্থন পাননি, ‘নাইটহুড’ ত্যাগ করে একাকী প্রতিবাদ করেছিলেন।
কি ভালোই না বাসতেন কবিগুরু সুকুমারকে। শয্যাশায়ী সুকুমারের বিছানায় মাথার পাশে বসে গান শুনিয়েছেন। তার প্রয়াণে শোক করেছেন। এমনকি প্ল্যানচেট এ ডেকেছেন সুকুমারকে ( এই প্ল্যানচেট বিষয়টি সত্যি-মিথ্যা যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ যে প্রশ্নগুলি করেছিলেন তার থেকেই বোঝা যায় এই মানুষটিকে কি গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং বয়সে ছোট হলেও সম্মান করতেন)।
পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘চৌধুরী’ উপাধি বর্জন করলেও তার চালু করা ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সাফল্যের সাথে পরিচালনা করছিলেন ১৯১৫ সাল থেকে। বিলেতের ‘রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’-র সদস্য ছিলেন। পুরস্কারও পেয়েছেন ছবি পাঠিয়ে। ছিলেন বিজ্ঞানের স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি নিয়ে বিলেত গেছিলেন কারিগরি শিক্ষার্থে । কালাজ্বরের ওষুধ আবিস্কৃত না হওয়ায় অকালে চলে গেলেন মাত্র ৩৬ বছ বয়সে। বুঝতে পারছিলেন থাকবেন না। তাই লিখলেন।
‘ আজকে দাদা যাবার আগে
বলব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই বা তাহার অর্থ হোক
নাই বা বুঝুক বেবাক লোক …।।
এই একটা ভুল করেছিলেন সেই মহামানব। বাঙালি তার লেখায় রস খুঁজে পেয়েছে, বেবাক লোকে তার লেখা বুঝেছে, যত দিন এগোচ্ছে তার নামে গড়ে উঠেছে ‘সুকুমার ক্লাব’। তার লেখা বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হচ্ছে। ক্রমশঃ তিনি এদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠছেন।
আমি আপনি ছোটবয়সে যে ছড়া লেখার মকশো করতাম, তা ভেবে লজ্জা পাবার কিছু নেই, কারণ স্বয়ং রবি ঠাকুর ‘ক্ষান্ত পিসির দিদি শাশুড়ির একজন থাকে কালনায়’ জাতীয় ছড়া লিখেছেন অনুপ্রাণিত হয়ে (‘খাপছাড়া’ প্রকাশ পায় সুকুমার দেহ রাখার তের বছর বাদে ) । কৈশোরের ডায়েরি ঘেটে এ অধমের একটি ছড়া তুলে দিচ্ছি এই সুযোগে । ৩০ শে সেপ্টেম্বর তার জন্মদিনে এটাই আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ঝকমকে দিনে ঠাসা চকমকে আলো
মেঘলার পরে তাই বেশ লাগে ভালো ।
চনমনে মন আজ আনমনা দিনে
ভুলে যাও ছিল কাল রাত ঘিনঘিনে ।
প্রাণ ভরে গান গাও, তাল দাও তাল
সাথে থাক দুনিয়ার বেবাক বেচাল ।
আমি বলি সে কেবল প্রকৃতির দোষ
খামোখা জগৎ জুড়ে কোপ ভরা রোষ ।
যত খাবে ভ্যাবাচ্যাকা, তত গাও গান
তুমি আমি সক্কলে সমান সমান ।।