রাত দিন (গল্প)
[kodex_post_like_buttons]
অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
কাল রাতটা সত্যি খুব ভয়ংকর কেটেছে।
রাতভর ঘুমুতে পারি নি।
আসলে একটা চাকরির ইন্টারভ্যু দিয়ে ছিলাম মাস তিনেক আগে। কর্পোরেশনের স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের পোস্ট।
তিন জন নেবে।দশ জনের প্যানেল হয়েছে।এবং সেই থেকে কচলা কচলি চলছে।
ডাক উঠছে নাবছে।
পঞ্চাশ থেকে আমি দু লাখ অবধি ডেকে,জমা করে এসেছি।শুনেছি আমার আগে দুলাখ কুড়ি একজন আছে।পরের জন এক আশি।
খবর টা বুল্টিদাই দিয়েছে।অবশ্য এ জন্যে তাকেও হাজার পাঁচেক দিয়েছি।
আমার দূরসম্পর্কের পিসতুতো দাদা বলেই মাত্র পাঁচ নিয়ে ভেতরের খবরা খবর দিয়েছে আমায়। গা শোঁকা শুকির সূত্রে আমার হয়ে চেষ্টা চরিত্রও করেছে অনেক।
কাজটা হয়ে গেলে একদিন ভরপেট্টাই মালের কথা দেওয়া আছে।দিন ও ঠিক। আজ বাদে কাল।
আজ দুপুরেই সেই চিঠি দেওয়া হবে জেনে আগের রাতে কারো ঘুম আসে?
বিশেষ করে তিরিশ পেরুনো বেকারের?
জানেন,পাশের ঘরে রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার বাবাও জেগেছিলেন রুগ্না মা’র সাথে।
টাকাটা বাবাই দিয়েছেন কিনা ব্যাঙ্কে রাখা ওই বোনের বিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট সামান্য রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট থেকে। সে ও প্রচুর আপত্তি তর্ক ঝঞ্ঝাটের পর, মরতে বসা মা’র মুখ চেয়ে।
চিঁ চিঁ গলায় মা ই বুঝিয়ে ছিলেন।
“দিয়ে দাও।কী হবে ও টাকা?
মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর আমারই বা ক’দিন?খোকনের চাকরীটা তো হবে।তোমার পেনশনেই আমাদের চলে যাবে,তারপর ওর চাকরীটা হলে, ও তো তোমার পাশেই রইলো।”
বাবার অবশ্য ঘুষ দিয়ে চাকরী নিয়ে খুত্ খুতানি যাচ্ছিলো না। ঠিক তখনই মা’র মাস্টার স্ট্রোক-
“মরার আগে খোকনের চাকরীটা হলে আমি একটু শান্তিতে মরতে পারি গো।তুমি চাও না?”
ব্যাস,ক্যাচ কট কট্!
সেই কেনা চাকরীটা হল কিনা, আজ দুপুরে জানবো।
বুল্টিদা বলেছে,আমার নাম দু নম্বরে।
তবু হাতে তো চাই চিঠি টা।
সকাল দশটা মানে সাড়ে ন টায় কর্পোরেশন অফিসে আমায় দেখে বুল্টি দা ফুট কেটেছিলো-
“কী রে?এসে গেছিস? বুঝলি, চাকরী পাবার আগে সবাই শালা পাংচুয়াল।মিল গয়া তো ব্যাস,লেট হাওয়ার শুরু! বোস বোস । একটু দেরী হবে। চেয়ারম্যান সাড়ে দশটার আগে আসে না। আমি খবর নিয়ে আসছি।”
ব্যাস্ , বেলা সাড়ে এগারোটা বেজে গেল বুল্টি দা বে পাত্তা!
লোক ঢুকছে বেরুচ্ছে,বুল্টিদা নেই।আমি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবো কিনা ভাবছি। বারোটা নাগাদ বুল্টিদা এসে কেমন যেন মিনমিন করে বলল-
“নেঃ, চ।”
আমি বুক ফুলিয়ে লম্বা বারান্দা দিয়ে এদিক ওদিক প্রায় পাঁচ মিনিট হাটলাম।আর ওই পাঁচ মিনিটে রঙীন ভবিষ্যৎ,মা এর রুগ্ন মুখ,টুকটুকে বউ,কত কি ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিলাম!
তাই খেয়াল করি নি চেয়ারম্যানের ঘর না,একটা ঘুপচি ঘরে ঢুকিয়ে বিল্টু দা বলল-
“নে বস”।
তারপর নিজেই একটা চেয়ারে বসে মাথা নীচু করে মূর্তি হয়ে রইলো কিছুক্ষন।
শেষে বলে বসল-“নাঃ রে হল না।দর সাড়ে তিন উঠে গেছে!
লোয়েস্ট বিট ই তিন লাখ।
নয় পেলে কেউ ছয় এ রাজী হয়? তুই ভাবিস না তোর জমা দেওয়া দু’লাখ পেয়ে যাবি। খালি হাজার দশেক ওই,এটা ওটা কেটে নেবে।এক নব্বই কাল পরশু ই দিয়ে দেবে!
তুই একটু বোস,চা বলি?”
আমার চারদিকটা অন্ধকার হয়েছিল।সব ফাঁকা!হাতে পায়ে জোর নেই।পাশের ঘরের চাকুরেদের হা হা হো হো হাসির হল্কা কান ভার করে বুকে চাপছিলো।বার বার বাবার মুখটা কেন যে চোখে ছায়া ফেলছিল কে জানে!
আমি নিশ্চিৎ বাবা ছানি ভরা চোখে আলো ফুটিয়ে বলবেই-
“ঠিক আছে। এই বেশ ভালো হয়েছে।তুই কিন্তু তোর মা কে কিছু বলিস না!কদিন বা বাঁচবে?
নয় ও কটা দিন অফিস যাবার নাটকটাই করিস। খুঁজতে থাক না কিছু না কিছু পেয়ে যাবি!”
ওই একটা দিনের কয়েকটা সংলাপেই সব ওলট পালট হয়ে গেল যেন আমার !
মা কে নমস্কার করে ছিলাম কিন্তু কিছু বলতে পারি নি।
তারপর মা আর সাত দিনই বেঁচে ছিল।
মরার আগে মা বিরবির করে যে কথাটা বলেছিল অস্পষ্ট শুনেছিলাম-“খোকন রে,ঘুষের টাকাটা ফেরৎ পেয়েছিস তো বাবা?দেখ,ও সম্মানের টাকা অসম্মানে না যেয়ে ভালই হয়েছে !তোর বাবা বড় মরমে মরে যাচ্ছিলেন রে!মাস্টার ছিল তো!মানুষ টাকে দেখে রাখিস।”