ম্যায় কেয়া রেন্ডি হু? গরমা গরম কাহানি লিখোগে?
আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ১)
সৌগত রায়বর্মন:
চম্বলে আমার দ্বিতীয় অভিযান ১৯৮৩ সালে। এবার মিশন ফুলন, মালখান, বাবা ঘনশ্যাম, মোহর সিং আর বুন্দেলখন্ড জঙ্গল। এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে চম্বল সম্পর্কে অন্যরকম কিছু জানকারি, নচেৎ পাঠক ভাবতেই পারেন যে এই প্রতিবেদক বোধহয় ভ্রমন কাহিনি লিখতে বসেছে। তাই একটু পন্ডিতি না করে পারা গেল না।
অনাদিকাল থেকেই চম্বল উপত্যকা ও বুন্দেলখন্ড জঙ্গল ডাকাত অধ্যুসিত অঞ্চল বলে কুখ্যাত। ইতিহাস অন্তত তাই বলে। প্রথম পর্বে এই প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী চম্বলের এই সাদাসিধে, অমায়িক, বিনয়ী মানুসগুলি কেন যে হঠাত গুড়ুম গুড়ুম করে গুলি চালিয়ে বেহড়ে ঘর বাধে তার কোনও আর্থ সামাজিক কারণ এখনো অবধি কেউ খুঁজে পাননি। আমি তো কোন ছার! এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, চম্বলের ডাকাত ও ডাকাতি সম্পর্কিত কোনও তথ্যই তিন উপদ্রুত রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থান সরকারের হাতে নেই। কেন্দ্রের হাতে যে থাকবে না তা জানা কথাই। যা আছে তা নেহাতই তাতক্ষনিক এবং দিনের পর দিন অবহেলিত হতে হতে এখন তামাদি হয়ে গেছে। তার জায়গায় যা আছে তা স্রেফ গাল গপ্প। হট উপন্যাসের মাল মশলা।
তাই গোয়ালিয়র জেলে ফুলন আমাদের দিকে তাকিয়ে জলন্ত দৃষ্টিতে বলেছিল, ম্যায় কেয়া রেন্ডি হু? গরমা গরম কাহানি লিখোগে? কুছ বাত নেহি করেগা, হাট ইহা সে।
তাও চম্বল নিয়ে যে ভাল বই লেখা হয়নি তা নয়। এই কাজ সম্ভব হয়েছিল দুটি মানুষের জন্য। বিনোবা ভাবে আর জয়প্রকাশ নারায়ণ । এই দুই সর্বদয়ী নেতা যদি দিনের পর দিন চম্বলের বেহড়ে বেহড়ে রোদে পুড়ে, ঝলসে ঘুরে ঘুরে প্রেমের বাণী না ছড়াতেন তাহলে এটা সম্ভব ছিলো না।
বিসয়টা কিন্তু এত সহজ ছিল না। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল আকাশ থেকে বোমা মেরে সমতল করে দিতে চেয়েছিলেন, চম্বল ও যমুনার বেহড়গুলি। নেহেরু অবশ্য তাতে বাধা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, তাহলে তো নিজের দেশের বিরুধ্যেই যুদ্ধ করতে হয়, সেই সরকারকেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিনোবা ভাবে, নবাব সিং, তহশিলদার সিংকে নিশ্চিত ফাঁসির দড়ি থেকে উধ্যার করে এনেছিলেন। তার স্লোগান ছিল, ‘ডাকাতদের হৃদয় পরিবর্তন’। একক প্রচেষ্টায় এই রকম একটা কাজ যে করা যায় তা ইতিহাস না ঘাঁটলে বোঝা যাবে না।
তহশিলদারের ফাঁসির হুকুম মেনে নিতে পারেনি চম্বলের সাধারণ মানুস। যদিও তহশিলদার ছেলে হিসেবে মান সিং এর সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন তবু তার বন্দুকের বুলেট কারোর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল বলে কোনো তথ্য পুলিশের খাতায় ছিল না।
কথিত আছে, খোলা মাঠে মান সিংকে যখন পুলিশ গুলি করে মারে তখন ওই অবস্থায় তহশিলদার সিং দলের সবাইকে বলে, আমাকে কার্তুজ দাও, আমি পুলিশকে আটকে রাখছি, তোমরা পালাও যতদুর পারো। এবং প্রায় ২৪ ঘন্টা নাকি পুলিশকে আটকে রেখেছিল তহশিলদার সিং। এরকম একটা লোকশ্রুতি আমরা প্রথমবার গিয়ে শুনেছিলাম। দ্বিতীয়বার কিন্তু ঠিক এর উলটো কথা শুনলাম। তহশিলদার একটি গুলিও চালায়নি। কারণ তাড়াহুড়োর সময় নাকি তাকে ভুল কার্তুজ দেওয়া হয়েছিল। প্রথমবার বয়েস কম ছিল, তাই রক্ত গরম করা এই গল্প বিশ্বাস করেছিলাম। এবং এই গল্প শুনেছিলাম মান সিং এর গ্রাম খেরা রাঠোরে। অবিশ্বাস করার কোনও কারণও নেই। বিরত্তের কাহিনি শুনতে কার না ভালো লাগে!
উলটো কথা শুনলাম দ্বিতীয়বার, এক সর্বোদয়ী নেতার কাছ থেকে। তিনি জয়প্রকাশের একান্ত ভক্ত। তিনি বলেছিলেন, তহশিলদার একটাও গুলি চালায়নি। ভুল কার্তুজের কারণে ২৪ ঘন্টা তো দুরস্থান, প্রায় বিনাযুদ্ধে পুলিশের হাতে ধরা পরে তহশিলদার। একে তো মান সিং নিহত, তার উপর তার দলের কাউকে তাড়া করে না ধরতে পেরে পুলিশ তহশিলদারের উপর খাঁড়া করল প্রায় শ’খানেক হত্যা ও ডাকাতির অভিযোগ। ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল তার, পাঠানো হল নৈনির জেলে। এক অন্ধকার সেলে একাকী থাকতে থাকতে সে দেওয়ালে আঁক কষে দিন ও রাতের হিসেব রাখত।
শোনা যায়, কারো পরামর্শে তহশিলদার নাকি বিনোবা ভাবে কে একটা চিঠি পাঠায়। তার মর্মস্পর্শি স্বীকারক্তি বিনোবা ভাবেকে স্পর্শ করে এবং শুরু হয় বিনোবার মিশন চম্বল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তহশিলদারের ফাঁসি রদ করা হয়। বদলে যে সাজা ঘোষিত হল তা আরও মারাত্মক, তাকে ২৪৬ বছরের জেল খাটতে হবে! হয়ত আরও তিনটে জন্ম জেল খেটে ২৫০ বছর জেলে কাটিয়ে দিতে পারত তহশিলদার সিং। কিন্তু তার মনোবাসনা পূর্ণ হল না। চম্বলের আকাশে উদিত হলেন আরেক মহাপুরুষ । নাম জয়প্রকাশ নারায়ণ। তার অনুরোধে সাড়া দিল প্রশাসন। মুক্তি পেল তহশিলদার সিং। খাদির ধুতি আর মোটা কূর্তা গায়ে নাম লেখালেন সর্বোদয়ীদের দলে। বেহড়ে বেহড়ে ঘুরে তিনিও ওড়ালেন শান্তির শ্বেতপতাকা।
এলো ১৯৭২ সাল। চম্বলের ইতিহাসে একটি গুরুত্মপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়েই চম্বলের সব চাইতে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা। এই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটাবার মূলে যারা তারা হলেন জয়প্রকাশ তো বটেই, সঙ্গে তহশিলদার সিং এবং অন্যান্য সর্বদয়ী নেতারা। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন ডাকাতদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে। আরও একজনের নাম করতে হয় সে মাধো সিং।
মাধো সিং যদিও ৫০০ জনের দল চালাতো, তবে ৭০/৭১ সালে তার দল ভাঙতে শুরু করে। আগের বছরেই পুলিশের সঙ্গে এক এনকাউন্টারে তার দলের ভয়ঙ্কর ১১ জন বাগী নিকেশ হয়ে গিয়েছিলো। তখন থেকেই সে প্রমাদ গোনে। বোঝে তার বাগী জীবন শেষ হয়ে আসছে। তখন থেকেই সে আত্মসমর্পণের রাস্তা খুঁজতে থাকে।
কিন্তু এ কাজ করার জন্য তাকে কে সাহায্য করতে পারে? একজনই আছেন তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণ। কিন্তু কিভাবে সে জেপিকে ধরবে? প্রায় ১ বছর মাধো জেপির পিছু পিছু ঘুরেছে, নানা ছদ্মবেশে।কিন্তু দেখা করতে পারেনি। এক সময় হতাশ হয়ে মাধো কলকাতায় আসে। তার উদ্দেশ্য ছিল নকশালপন্থীদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের দলে ভিরে যাওয়া । কলকাতা সহ সমস্ত পশ্চিম বঙ্গে তখন নকশাল রাজ চলছে। মাধো কোনও এক নেতার সঙ্গে দেখাও করে। মাধো স্মার্ট লোক। কথাবার্তায় চৌকশ। রাজপুতানা রাইফেলসের হাবিলদার ছিলো মাধো। কিন্তু কলকাতায় সুবিধে করতে পারল না সে। এক ডাকুকে নকশাল নেতা বানানোর ইচ্ছে ছিল না সেই নেতার। মাধোও বুঝল এটা বেহড় নয়, নেতাগিরি কলকাতায় চলবে না।
হতাশ হয়ে আবার জেপির পিছনে ছুট। সেই সময় প্রায় ভারত ভ্রমন করা হয়ে গিয়েছিলো তার। জেপি আর মাধোর মধ্যে ক্যাট এন্ড মাউস খেলা চলতেই থাকে। এই সময়েই একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাধোর মাথায়। সে একা তার ভাঙা দল নিয়ে স্যারেন্ডার করবে তাতে জেপিকে খুশি করা যাবে না। তাহলে উপায়? সে বুঝেছিল আন্যান্য দলগুলির সামনে সাদা পায়ড়া না ওড়ালে জেপি তাকে পাত্তা দেবে না। সেই সময় মাধোর সঙ্গে টক্কর দিতে পারে এমন দল একজনেরই আছে। সে মোহর সিং। চম্বলের বিরাট সেলিব্রিটি। হ্যাঁ চেহারটাও দেখার মতো। টকটকে গায়ের রং, যাতে গুজ্জর। তাকে গোঁফ দিয়ে যায় চেনা। মোহরের গোঁফ যদি মাথার জটা থেকে মুক্ত করা হয় তাহলে মাটিতে একটা প্রমান সাইজের গালিচা পেতে দেওয়া যেতে পারে।
পুলিশ নাকি তক্কে তক্কে থাকত, বা মুখবির বা গুপ্তচরদের কাছ থেকে খবর নিত বাগীজী কখন তার গোঁফ চর্চায় বসবে। ঠিক তখনই পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলবে। পুলিশ বিশ্বাস করত, গোঁফ পরিচর্জা ছেড়ে বাগীজী পুলিশের দিকে তাকেবেই না। গুলি,মৃত্যু, জেল, ফাঁসি সব কিছুই তার কাছে তখন মায়া কুহেলিকা।
নিজের চোখে দেখেছি কতটা মমতা নিয়ে মোহর গোঁফের যত্ন নেয়। তেলে চুবিয়ে গোফ মালিস করে, পাকিয়ে সে চুলের সঙ্গে মিলিয়ে দিত। এই কাজে তাকে সাহায্য করত প্রায় সাত জন এসল্ট রাইফেলধারী ডাকু। মাধো বাচুক কী মরুক তার গোঁফের যেন কোনও অবহেলা না হয়।
এ হেন মোহর সিং চম্বল পুলিশের কাছে ছিল মোস্ট ওয়ান্টেড, মোস্ট রুথলেস, মোস্ট ডেঞ্জারাস, মোস্ট নটরিয়াস ডাকু। মাধোর কাছে মোহর ছিল সব চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। তাকে স্যারেন্ডার করতে রাজি করানো সব চাইতে টাফ কাজ। মাধো মোহরের সঙ্গে বেহড়ে মোহরের ডেরায় দেখা করতে যায় বিনা অস্ত্রে। গুর্জর কখনও ঠাকুরকে নিরস্ত্র অবস্থায় মারবে না। সেই বিশ্বাস মাধোর ছিল।
সারা রাত দুই সর্দারের কথা হল। মাধো কিছু শর্ত আরোপ করতে চেয়েছিল। গর্জন করে উঠল মোহর সিং। বলল, পুলিশের তরফ থেকে কোনও শর্ত আমি শুনব না। আমাদের শর্ত ওদের মানতে হবে।
অবশেষে মোহর রাজি হল, মাধোর তখন চোখ ফেটে জলের ধারা। তার এতদিনের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে।
মোহর রাজি হওয়া মানেই আন্যান্য দলগুলি আপসেই আত্মসমর্পন করবে, কারণ তাঁদের দলের তেমন শক্তি নেই। মাধোর পর আর বাকি থাকল একজনই নাথু সিং। তাকে রাজি করালেই মিশন সাকসেস ফুল।
নাথুও রাজি হয়ে গেল।
ক্রমশ