শেষ বারের মতো আয়নায় নিজের মুখটা দেখে নে, আর চান্স নাও মিলতে পারে !
আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ৬)
সৌগত রায়বর্মন:
সকাল পাঁচটার সময় সদর দরজার বাইরে প্রবল আওয়াজ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সর্বনাশ, রামসুন্দর কি আবার আমাদের গুলি করতে আসছে? তাও এত লোকজন নিয়ে। দিব্যকে ধাক্কা মেরে তুলে দিয়ে বললাম, ওরা আসছে, চল পালাই। আমি রীতিমতন ভয়ে কাঁপছি। দিব্য আমাকে ধাক্কা মেরে বলল, শাট আপ। এত চিৎকার কেন তা জানতে হবে।
এই বলে ও বাইরে চলে গেল।
আমি ক্যামেরাটাকেই ইটের ডেলা ভেবে নিয়ে জ্যাকি চ্যানের মতো স্টান্ট নিয়ে দাঁড়ালাম। কেউ মারতে আসলে ক্যামেরা ছুড়ে তো মারি, তারপর যা হবার তা হবে।
গতকালের নেশায় তখনো মাথা ভন ভন করছে। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
কিচুক্ষন বাদেই শুনলাম দিব্য ডাকছে। বেশ তড়বড়ে গলা। বুঝলাম ভয়ের কিছু নেই।
বাইরে বেড়িয়ে দেখি, প্রায় গোটা পনেরো জন তাগড়াই লোক কাঁধে বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। রামসুন্দর আর দিব্য খুব গম্ভীর ভাবে কিছু একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। বুঝলাম কাল রাতের ঘটনা মনে নেই রামসুন্দরের। ভোরের আলো চোখে লাগতেই মনে পড়ে গেল, আরে আজ তো আমাদের বাবা ঘনশ্যাম দিবস। ক্যাপ্টেন রামসুন্দর।
দিব্য চিৎকার করে বলল, আগে মাঠে পটি করে আয়, তারপর শেষ বারের মতো আয়নায় নিজের মুখ দেখে নে। পরে আর সে চান্স নাও মিলতে পারে।
সত্যিই তো আজ আমরা বুন্দেলখন্ড জঙ্গল কি কোনে কোনে মে ঘুমেগা ঘনশ্যামকে লিয়ে। মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল। মাকে আর দেখতে পাবো তো? বাট অভিযাত্রী নেভার ক্রাই। আমিও কান্না চেপে বাইরে এলাম। গলায় ক্যামেরা, মাথায় টুপি, পায়ে বাটার হান্টার শ্যু। এখনো তেমন রোদ ওঠেনি। তাই এই সকালে আর অরন্যদেব সাজলাম না।
রামসুন্দরের নেতৃত্বে যে পনেরো জন আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে, তাদের গোটা পাঁচ জনের কাধে বন্দুক, বাকিদের জলের ভিস্তি। রুক্ষ জঙ্গলে জল পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর আমদের চড়াই ভেঙে উঠতে হবে ওপরে। তার উপর তীব্র রোদের তেজ। এখানে সোনালী রোদের তাপে মানুষের চামড়া তো কোন ছাড়। পাথড় পর্যন্ত শুকিয়ে বেলে মাটি হয়ে যাচ্ছে। ওই তীব্র দহন জ্বালা লিখে বোঝানো যাবে না।
এ ক্ষেত্রে পরোক্ষ অনুভূতি বলে কিছু হয় না। পিঠের চামড়া না পুড়িয়ে এই অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় না।
সকাল ছ’টা। আমাদের যাত্রা হল শুরু।
কিন্তু কে এই বাবা ঘনশ্যাম? যার দেখা পাওয়ার জন্য আমরা দুই বাঙালি সন্তান অবশেষে কলকাতা ছেড়ে বুন্দেলখন্ডে আত্মাহুতি দিতে এলাম নিজেদের। আমার বাড়ির পাশেই তো রেল লাইন ছিল !
বাবা ঘনশ্যাম নিম্নবর্গের ডাকাত। জাতিতে মল্লা বা মাঝি। নিবাস এই বুন্দেলখন্ড। ঘনশ্যামকে ঠিক চম্বলের ডাকাত বলা যায় না। বুন্দেলখন্ড ভারতের দরিদ্রতম অঞ্চল বলে কুখ্যাত। একে তো বিশাল অরন্য। তার ওপর রুক্ষ ভূমি। অনুর্বর। ভৌগলিক কারনেই এখানকার মানুস নিতান্ত গরিব এবং সামাজিক সংস্কারে নিম্নবর্গের। অর্থনীতির এই অসম বিকাশের ফলেই বুন্দেলখন্ডের মানুয ডাকাতিকেই তাদের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।
এই অঞ্চলের অরন্যভূমি তাদের বিচরণ ক্ষেত্র। পুলিশ বহু চেষ্টা করেও এই ডাকাত দলগুলোকে বাগে আনতে পারেনি।
বাবা ঘনশ্যাম তাদেরই মতো এক খুঁখার ডাকু। তার অনেক নাম। মুস্তাফা বলেও তাকে অনেকে ডাকতো।
ফুলনের বেহমাই হত্যাকান্ডের সঙ্গে ঘনশ্যামের যোগাযোগ নিবিড়। ফুলনের জন্মস্থান বুন্দেলখন্ডের জালাউনে। আগেই বলা হয়েছে ঘনশ্যাম ওই অঞ্চলেরই।
ধর্যিতা ফুলনের প্রতিহিংসায় সাহায্য করেছিল বাবা ঘনশ্যাম।
শুনেছি, ফুলন নিজের হাতে একটা গুলিও চালায়নি। বেহমাইতে ২২ জন ঠাকুর ধর্যককে একের পর এক গুলি চালিয়ে নিকেষ করেছিল যে সে বাবা ঘনশ্যাম।
ফুলনের সময় সেও বন্দুক সমর্পণ করেছিল ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, ততকালীন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এর কাছে।
আমরা এই মহান বাবার খোঁজেই যাচ্ছি, উড়ো খই গোবিন্দায় নম: বলে।
ক্রমশ