হাড়ি ভাসিয়ে থৈথৈ খালে সাঁতার কেটে প্রতিদিন স্কুলে চার কন্যা
কলকাতা টাইমস :
প্রতিদিন দুটো খাল পেরিয়ে স্কুলে যায় তারা। বন্যার কারণে নতুনপাড়া গ্রাম থেকে চান্দুপাড়া ও আশপাশের পাঁচটি বিদ্যুত্হীন গ্রাম যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। তাই শনিবার নতুন গ্রামে পৌঁছলেও নৌকা না থাকায় আমার পক্ষে ওপাড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নতুন গ্রামে আমার পৌঁছার খবর পেয়ে সাঁতার কেটে সদর উপজেলার চান্দুপাড়া থেকে নতুন গ্রামে স্কুলে যাওয়ার মতো করেই ছুটে আসে নদীপারের অতিদরিদ্র পরিবারের চার শিক্ষার্থী রুনা লাইলা, সুলতানা খাতুন, পারুল ও তাসলিমা খাতুন। তারা অনুপনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। বলল নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ও সাঁতার কেটে স্কুলে যাতায়াতের গল্প। বাড়ি ও গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় ঘরে ফিরে দিনের আলোতেই স্কুল ও পরীক্ষার লেখাপড়া সেরে ফেলতে হয় তাদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কে জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এবং বাসুদেবপুর থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে অনুপনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুলটি। এর পশ্চিমে পৌনে এক কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার ৭ নম্বর চর অনুপনগর ইউনিয়নের বিদ্যুত্হীন ‘নতুনপাড়া গ্রাম’। এ গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মহানন্দা নদীতীরে চান্দুপাড়া গ্রাম। নতুনপাড়া গ্রামের শেষ মাথা থেকে চান্দুপাড়া পর্যন্ত বন্যার জলে ডুবে আছে। বন্যার জল কমে এলেও চান্দুপাড়া ও টিকরাপাড়া দুটি খালের জল সরে যেতে সময় লাগে আরো দুই মাস। চান্দুপাড়া থেকে নতুন গ্রামে বা শুকনো জায়গায় পৌঁছতে কোনো নৌকার ব্যবস্থা নেই। গ্রামের এক হাজার মানুষকে সদর উপজেলায় বা নতুন গ্রামে আসতে হয় সাঁতার কেটেই। চান্দুপাড়ার এই মেয়েদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার, সে হিসেবে আসা-যাওয়া মিলিয়ে পাঁচ কিলোমিটার যাতায়াত করতে হয় তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে। এর মধ্যে পড়ে ৮০০ ফুট প্রশস্ত জল থৈথৈ দুটি খাল। নৌকা না থাকায় সাঁতরেই খাল পেরিয়ে স্কুলে যায় রুনা লাইলা, সুলতানা খাতুন, পারুল ও তাসলিমা খাতুন। এলাকাবাসী ও নদীপারের এই চার ছাত্রীর দাবি—বর্ষা ও বন্যা মৌসুমে চার মাসের জন্য পারাপারের নৌকার ব্যবস্থা বা দুটি খালে কালভার্ট নির্মাণ।
রুনা পড়ে অনুপনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে। তাদের খাল পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া বিষয়টা বিস্তারিত বলল সে। যখন তারা চারজন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, তখন স্কুলের ড্রেস, বই, খাতা-কলম একটি বড় অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িতে রেখে মাথায় করে হাঁটতে শুরু করে। খালের কাছে আসার পর অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িটি জলে ভাসায় এবং কিনারে না পৌঁছা পর্যন্ত হাঁড়িটি সযত্নে দুই হাত দিয়ে ধরে রেখে সাঁতার কাটতে থাকে। এভাবে বন্যা ও পরবর্তী দুটো মাস ভীষণ কষ্ট করেই যাতায়াত করতে হয় স্কুলে। সাঁতার কেটে কিনারে উঠে আরো কিছুদূর হেঁটে নতুনগ্রামে পৌঁছে। তারপর কারো বাড়িতে গিয়ে হাঁড়িতে থাকা স্কুল ড্রেসটি পরে। কখনো স্কুলেও ড্রেস বদল করে। ক্লাস শেষ করে আবারও স্কুল ড্রেস বদলে আধ ভেজা পোশাকটি পরে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
তাসলিমা খাতুন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। তার বাবা আবুল কাশেম মারা গেছেন আট বছর আগে। তারা পাঁচ ভাই ও চার বোন। আবুল কাশেম ছিলেন কৃষি শ্রমিক।
সুলতানা, পারুল, রুনা ও তাসলিমা কাছ থেকে জানতে পারলাম, তারা চারজন সাঁতার কেটে স্কুলে গেলেও সাঁতার না জানায় একই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া তাদের এলাকার ফাতিমা, শারমিন ও ইয়াসমিন স্কুলে যেতে পারে না। প্রায় চার মাস ওদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। তাসলিমার বিকল্প প্রস্তাব, এই চার মাসে স্কুলের আশপাশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কেউ করে দিলে এমন ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হবে না।
কেন এত বাধা পেরিয়েও স্কুলে যায় জানতে চাইলাম। বলল, তার বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই পরিবারের কথা ভেবে বিদেশে গিয়েছেন। তিনি বাড়িতে যে টাকা পাঠান তা যথেষ্ট নয়। দারিদ্র্যের কারণে তৃতীয় শ্রেণিপড়ুয়া ছোট ভাই ছাড়া তাসলিমার ভাই-বোনদের কেউ স্কুলে যায়নি এবং তার তিন বোনের খুব কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। তাসলিমা বলে, আমরা খুব গরিব, তবু আমি নিজেকে শিক্ষিত করতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। যেন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করে পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে পারি।