November 22, 2024     Select Language
৭কাহন Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

অ্যাসিম্পটোম্যাটিক

[kodex_post_like_buttons]

ভাবুক বাবুর ভাবনা 

প্রায় তিন দশক আগের কথা, আমার বড় কন্যার বয়স তখন এক বা দু বছর। প্রচন্ড সর্দি-কাশিতে ভুগছিল। আমরা কত্তা গিন্নী ওকে নিয়ে গেলাম এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছে। এখানে বলে রাখা ভাল, আমার শ্বশুরবাড়িতে গুষ্টিশুদ্ধ হানিম্যানের ভক্ত। আর আমার বাপের বাড়ির রক্ষাকর্তা ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম বিশু ডাক্তার (অ্যালো)। যাই হোক, প্রতিবারের মত সেবারেও শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করে চলে গেলাম হানিম্যানের হয়ত বংশধর সেই হোমিওপ্যাথের কাছে। যতদূর মনে পড়ছে, তিনি প্রশ্ন করলেন- সর্দি কি ডান নাক দিয়ে বেরোচ্ছে না বাঁ নাক দিয়ে? আমি  বোকার মত বলে উঠলাম-  আজ্ঞে দু নাক দিয়েই। ডাক্তারবাবু খুব চিন্তিত মুখে বললেন- ব্যাপারটা সিরিয়াস। আচ্ছা, সর্দিটা গরম না ঠান্ডা? আমি বললাম, আজ্ঞে গরমই হবে মনে হয়। ডাক্তারবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ওরকম মনে হয় বললে হবে না। সর্দিটা কি আঠালো? ওতে টকটক গন্ধ আছে? আমি বললাম, আজ্ঞে অত তো খেয়াল করিনি। ওই তো নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে, আপনি একটু দেখুন না টকটক না অন্য কিছু। ডাক্তারবাবু শান্ত ভাবে বললেন, সিম্পটম না বিচার করে ওষুধ দেওয়া হানিম্যানের বারণ আছে বাবা। আমি তো সবে তিন চার নম্বরে এসেছি, মোট একশো আটটা প্রশ্নের উত্তর না পেলে ওষুধ দিই কি করে? পুরো সিম্পটম না জানলে আর্ণিকা না ভিতরকণিকা কোনটা দেব সেটা ঠিক করব কি করে?

শুধু হোমিওপ্যাথ নয়, অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসাপদ্ধতিও খানিকটা এরকমই ছিল। ছোটবেলায় আমার খুব জ্বর হত বলে প্রায় প্রতি সোমবার ডাক্তারবাবু আমার ব্রহ্মতালু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত স্টেথো লাগিয়ে বসে থাকতেন। একবার পেটে ব্যাথা বলায় পরীক্ষা করতে গিয়ে পেটে এমন চিমটি কেটেছিলেন যে আমার অ্যা পেয়ে গিয়েছিল। আমার চোখ, নাক, গলা বুক দেখে নিদান দিতেন (প্রতিবারই এক) – আগামী পাঁচদিন শুধু বার্লি সাবু খাবে।

কোভিড ১৯ হানা দেওয়ার পর এখন সব বদলে গেছে। নতুন নতুন শব্দের মধ্যে এসেছে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক নামের প্রায় দুর্বোধ্য একটি শব্দ। মোটামুটি মানে হল- অসুখ আছে কিন্তু তার কোনও লক্ষ্মণ নেই। এই তো সেদিন আমাদের জগন্নাথ সেন শর্মা এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তারবাবু মহাকাশচারীর পোশাক পরে প্রায় বাইশ গজ দূর থেকে প্রশ্ন করলেন- কি হয়েছে আপনার? জগন্নাথবাবু সবে বলেছেন- আজ্ঞে গত চারদিন ধরে ….  ডাক্তারবাবু থামিয়ে দিয়ে বললেন- জ্বর? জগন্নাথবাবু বললেন, না, না …..,  ও বুঝেছি, বুঝেছি, আপনার ডায়েরিয়া হয়েছে। জগন্নাথবাবু করুণ মুখে বললেন, না, না, মানে গত চার দিন আমার হাগু হচ্ছে না, তাই…… ডাক্তারবাবু ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি যখন বলেছি আপনার ডায়েরিয়া হয়েছে, তখন তাই হয়েছে। ওটা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক। আপনি টের পাচ্ছেন না। আপনার পটি আটকে গেছে, ওটা সিম্পটম। সিম্পটম নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। যে যে সিম্পটম আপনার নেই সেগুলির চিকিৎসাই আগে করতে হবে। আপনার কনস্টিপেশনের সিম্পটম আর ডায়েরিয়া অ্যাসিম্পটোম্যাটিক। আমি আপনার ডায়েরিয়া নিয়েই বেশি চিন্তিত।

রোজই হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি থেকে বার্তা পাই- সাবধান, আপনার চারপাশে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক করোনা পজিটিভ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের এড়িয়ে চলুন। যাদের জ্বর , সর্দি কাশি আছে তাদের নিয়ে কোনও ভয় নেই। করোনা তাদের শরীরে ঢুকে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু আপনার চারপাশে গিজগিজ করছে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক করোনা পজিটিভরা।

ডাক্তারির সংজ্ঞাটাই বোধ হয় বদলে গেল। শোনা কথা, সরকারের তরফ থেকে নাকি এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করা হয়েছে যাদের কাজ প্রতিটি বাড়ি ঘুরে আপাত “সুস্থ” লোকজনদের ধরে ধরে কপালে “অ্যাসিম্পটোম্যাটিক” উল্কি কেটে দেওয়া।

শোনা যাচ্ছে, হাবুলের স্ত্রী হাবুলকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হাজব্যান্ড কারণ সে বাড়ির কোনও কাজ করে না। তারপর থেকে আমিও ভয়ে ভয়ে আছি।

পাকে চক্রে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিল শ্রীমতি। দীর্ঘ লকডাউনের ক্লান্তি বাসা বেঁধেছিল শ্রীমতির মনে- তাই পরকীয়া। এ নিয়ে স্বামী মহাদেব রুষ্ট হয়ে একদিন রুদ্রমূর্তি ধারন করে বললেন, তুমি আমার স্ত্রী হয়ে ওই ছোটলোকটার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করছ? শ্রীমতি তখন মিষ্টি হেসে বললেন, আমি তো ঠিক তোমার স্ত্রী নই, অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বউ বলতে পারো।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও অ্যাসিম্পটোম্যাটিকদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে অনেক সময়ই মনে হয় , তিনি অ্যাসিম্পটোম্যাটিক সিপিএম। শুভেন্দু অধিকারী অ্যাসিম্পটোম্যাটিক  বিজেপি, এতদিন মোটেই বোঝা যায়নি। আমাদের দীলুবাবু যে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বলদ তা এখন ক্রমেই বোঝা যাচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় যারা রোজ ঝগড়া করে তারা যে আদতে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ঘেউঘেউ, তা নিয়ে নিশ্চয় কারও দ্বিমত  নেই? আব্বাস যে নমাজ পড়া মার্কসিস্ট, তা এতদিনে জানলাম! আসলে নিজের আসল পরিচয় কেউ আর আজকাল দিতে চায় না। কাউকে চেনা খুব মুশকিল । নরেন যে এত বড় মিথ্যেবাদী , তা কেউ বুঝতে পেরেছিল? একেবারে প্যাথলজিকাল অ্যাসিম্পটোম্যাটিক লায়ার। এসব কথা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। সবাই অ্যাসিম্পটোম্যাটিক। আমিও। কী , সেটা এবার ফাঁস করা যাক।  

করোনা আক্রমনের অনেক আগে আমার শ্বাশুড়ি ঠাকরুনের ইউএসজি রিপোর্ট নিয়ে এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। ডাক্তারবাবু রিপোর্ট দেখে আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন, আপনার ইউটেরাস একটু এনলার্জড, ওভারি দুটোর একটা বড়, একটা ছোট। আজই ভর্তি হয়ে যান, কাল অপারেশন করতে হবে। আমি থতমত খেয়ে বললাম, না, মানে, আমি না, এটা …. । ডাক্তারবাবু দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, সবাইকে দেখলে বোঝা যায় না। লজ্জা না পেয়ে অপারেশনটা করিয়ে নিন।

সেই থেকে আমি অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হয়ে আছি। আমাকে দেখলে কেউ বোঝে না, আমি শরীরে ইউটেরাস, ওভারি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমারই কেমন সন্দেহ হয়।

অতএব, সাধু সাবধান। অ্যাসিম্পটোম্যাটিক ধরা খুব শক্ত, চারিদিক ভাল করে লক্ষ রাখুন।

Related Posts

Leave a Reply