মৃতদেহ টানতে টানতে মনে হতো নিজেই মৃত
শৈশবের সুখস্মৃতি বলতে যা বোঝায়, আসলে তেমন কিছুই নেই আমার জীবনে। শৈশব-কৈশোরজুড়ে যা ছিল, তার প্রায় সবটুকুই দুঃস্বপ্নের মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল সবখানে। আমার জন্ম সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায়। মা-বাবার সঙ্গে বাস করতাম পাঁচ ভাই-বোন। একমাত্র ভাই এমেরিচ রোথ, সবার বড়। আমি তৃতীয়। বাবা স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়ে। অভাব-অনটনে কাটছিল আমাদের দিন। চেকোস্লোভাকিয়ায় যে গ্রামে আমরা ছিলাম, তা ছিল হাঙ্গেরির অধীনে। এ জন্য বাড়িতে কথা বলতাম হাঙ্গেরিয়ান ভাষায়। তবে আমি পড়ালেখা করতাম চেকোস্লোভাকিয়ান স্কুলে।
১৯৩৯ সালের শেষের দিকে। একদিন একজন মহল্লার সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, আমাদের সব ইহুদি পরিবারকে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। এর পর থেকে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম।
১৯৪৩ সালে। তখন আমার বয়স ১৬ বছর ছয় মাস। গ্রাম থেকে ধরে বন্দিবোঝাই ট্রেনে তোলার পরও জানতাম না কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু বুঝতে পারছিলাম, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। যখন ট্রেন থেকে নামানো হলো, তখন দেখলাম অশউইত্জ বন্দিশিবির। যুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির দখল করা পোল্যান্ডের এই অশউইত্জ বন্দিশিবিরই ছিল সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর। ছিল মানুষ পোড়ানোর শ্মশান। সেখানে পৌঁছেই খুব ভয় পেয়েছিলাম। ওরা আমাদের দলে দলে ভাগ করেছিল। আমি আর বড় বোন এডিথ ছিলাম এক দলে, মা ও ছোট দুই বোন অন্য দলে। ভাই ও বাবাকে তখন দেখিনি। তাঁরা অন্য কোথাও ছিলেন। নাৎসি সেনারা এডিথ ও আমাকে যখন টেনেহিঁচড়ে শিবিরের একদিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কাঁদতে কাঁদতে মা ও ছোট দুই বোনকে শুধু হাত নেড়ে বিদায় জানাতে পেরেছিলাম। তারাও খুব কাঁদছিল। এরপর আর তাদের খোঁজ পাইনি।
সেখানকার অনেক কিছুই এখন মনে নেই। ক্যাম্পে আমার কিছু বন্ধু ছিল। একই গ্রাম থেকে এসেছিলাম। এক খাটে ঘুমাতাম তিনজন। জায়গাস্বল্পতার কারণে সবাই একদিকে মুখ করে পাশকাত হয়ে শুতাম। ঘুমের মধ্যে একজন পাশ ফিরলে বাকি দুজনকেও একই দিকে পাশ ফিরতে হতো। সেই বন্ধুরা আমার ১৭তম জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা ভান করেছিলাম সুখী এবং খুশি হওয়ার। একসঙ্গে গান গেয়েছিলাম। বন্ধুরা আমাকে এক টুকরা রুটি উপহার দিয়েছিল, যা আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। খাবার নিয়ে বন্দিদের মধ্যে মারামারি লেগেই থাকত। ক্ষুধার যে তীব্র যন্ত্রণা আমরা বয়ে বেড়াতাম প্রতি মুহূর্ত, তা তুলনা করার মতো কিছু পৃথিবীতে আজও খুঁজে পাইনি।
আমার সঙ্গে বড় বোন ছিল। সেনারা প্রায়ই আমাদের ঘুম থেকে তুলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখত। এডিথ মাঝেমধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। বেশি কাপড়চোপড়ও ছিল না আমাদের। চুল কেটে ন্যাড়া করে দিয়েছিল। একদিন এডিথ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লে সুস্থ বন্দিদের থেকে আলাদা করতে ক্যাম্পের ভেতরেই অন্য একটি জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। তখন কেউ অসুস্থ হলে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করার জন্য ওই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। বোনকে যখন সেনারা নিয়ে যাচ্ছিল, আমিও পেছনে পেছনে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখে ভয়ে দৌড়ে চলে এসেছিলাম অসহায় বোনকে মৃত্যুর দুয়ারে রেখে। তাঁর আর খোঁজ পাইনি। এ জন্য নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারিনি!
বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলত। উলঙ্গ করে সবার সামনে ঘুরিয়ে বিকৃত উল্লাস করত কিংবা একটুতেই গুলি করে দিত! এই বন্দিশিবিরেই বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে। এ ছাড়া নির্যাতনের মধ্যে ‘ডেথ-মার্চ’ ছিল ভয়ংকর একটা। ডেথ-মার্চ হচ্ছে বিরতিহীন হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে মুখ থুবড়ে পড়ে মরে যাওয়ার নাম ডেথ-মার্চ। বাঁচার জন্য হাঁটা। সে হাঁটা যেন শেষ হতো না। মুক্তি পাওয়ার পর ভাই এমেরিচের কাছে শুনেছি, একদিন ডেথ-মার্চ চলাকালে আমার অসুস্থ-পঙ্গু বাবাকে যখন আর পিঠে বহন করতে পারছিলেন না, তখন পথে ফেলে রেখে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন এমেরিচ। তার পর থেকে বাবার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
সেখানে অনেক কাজ করতে হতো। কোনো দিন মাঠে ঘাস কাটা বা আগাছা পরিষ্কার করাত আবার কোনো দিন হয়তো কারখানায়। পেরেক মারার কাজ ছাড়াও যন্ত্রপাতিতে স্ক্রু লাগানোর কাজ করতাম। হাতে ফোসকা পড়ে যেত। অবশ হয়ে যেত শরীর। কিন্তু টুঁ শব্দটিও করতে পারতাম না। দায়িত্বরত নাৎসি নারীরাও ছিল হিংস্র। ওরা খারাপ ব্যবহার ছাড়াও শারীরিক নির্যাতন করত খুব।
একদিন ওরা জিজ্ঞেস করল, কে কে সহজ কাজ করতে চাও? আগপাছ না ভেবেই আমি ও আমার এক সঙ্গী হাত তুললাম। এরপর আমাদের দিয়ে ওরা যে কাজ করাল তার চেয়ে কঠিন কাজ হয়নি। সেখানে প্রতিদিন যে মানুষগুলোর মৃত্যু হতো, তাদের পোড়ানোর জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে হয়েছে আমাকেও। ওই বয়সে আমার জন্য সে কাজ যে কতটা ভারী ও যন্ত্রণার ছিল, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। মৃতদেহ বহন করতে করতে একসময় নিজেকেও মৃত মনে হতো।
একদিন এক বন্দি মা তাঁর একমাত্র শিশু সন্তানটি মারা গেলে বিলাপ করছিলেন। তখন নাৎসি নারীরা সেই মায়ের পা শিকল দিয়ে বেঁধে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর আমাদের জড়ো করে যন্ত্রণায় চিৎকাররত সেই মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। সেই মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখা যে কতটা মানসিক যন্ত্রণার, তা ওই অবস্থায় না পড়লে কেউ বুঝবে না। ওরা একবার আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল।
একদিন খেলে জানতাম না পরে আবার কবে খেতে পাব! খাবার বলতে জলে ফোটানো স্যুপজাতীয় কিছু। তীব্র ক্ষুধা নিয়ে রাতে যখন ঘুমাতে যেতাম, মনে পড়ত মায়েদের হাতের সুস্বাদু খাবারের কথা। এতই ক্ষুধার্ত থাকতাম যে বিছানা থেকে ওঠারও শক্তি পেতাম না। তখন যারা একসঙ্গে এক খাটে থাকতাম, তারা বিছানায় শুয়ে থেকেই মুখে মুখে রান্নার অভিনয় করতাম; ঠিক রান্নাঘরে যেভাবে মায়েরা রান্না করতেন। হয়তো একজন বলল, ধরো উনানে হাঁড়ি বসিয়েছি; একটু পর আরেকজন বলল, জল ফুটছে; এরপর আরেকজন বলল, এর মধ্যে মাংস বা সবজি দিয়েছি, মসলা দিয়েছি…ইত্যাদি। মানে মিছেমিছি কল্পিত রান্না, তার পরও কিভাবে জানি না, এই রান্নার খেলা শেষ হলে বাতাসে সে খাবারের চমৎকার ঘ্রাণ পেতাম, অনুভব করতাম সে খাবারের স্বাদ। মুখে মুখে রান্না করা খাবারগুলো তখন মনে মনে খেতাম। বেশ তৃপ্তিও পেতাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম, টের পেতাম না। পেট ভরে খাওয়ার অনুভূতি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। না খেতে খেতে আমাদের চিন্তাশক্তিও ঠিকমতো কাজ করত না।
ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। একদিন সারিবদ্ধ লাইনে আমাকেও দাঁড় করানো হয়েছিল। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য এ লাইন থেকে লোক বাছাই করা হচ্ছিল। আমি আর আমার দুই বান্ধবী সেই লাইন থেকে পালিয়ে অন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, যে লাইন থেকে পাঠানো হচ্ছিল অন্য কাজে। প্রথম লাইনের সামনেই ছিল কয়েকটি হলুদ দালান। সেদিকে তাকাতেই দেখি, জানালাগুলোতে ঝুলছে বহু মানুষ। তারা চিৎকার করছে, কাঁদছে, সাহায্যের জন্য ডাকছে। সে দৃশ্য ছিল ভয়ংকর। বুঝতে পারছিলাম না দালানের ভেতরে কী হচ্ছে। আগপাছ না ভেবেই ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে কঠোর পাহারায় থাকা সেনারা আমাদের গুলি করতে পারত। এখনো আশ্চর্য হই, কিভাবে সেদিন এ কাজ করতে পেরেছিলাম!
১৯৪৫ সালে হিটলারের পতনের পর মুক্তি পাই । যুদ্ধ যখন শেষ হলো, নাৎসিরা বুঝতে পারছিল না আমাদের নিয়ে কী করবে। তখন তারা শত শত বন্দিদের সঙ্গে আমাকেও একটি ট্রেনে তুলে দিয়েছিল। ট্রেনটি কিছুদিন পেছনের দিকে চলে, তারপর আবার সামনের দিকে। এভাবে চলেছিল ১০ দিন। ট্রেনে খাবার অথবা পানি ছিল না। কত মানুষ ট্রেনে মারা গিয়েছিল তার হিসাব নেই। চোখের সামনে বহু মানুষ মরতে দেখেছি, লাশের স্তূপ দেখেছি। মৃত্যুও সেদিন আমাকে স্পর্শ করেনি। কোনো ভয় বা কষ্টের অনুভূতি সেদিন আমার ছিল না। বাঁচা-মরার ভাবনা কিভাবে ভাবতে হয়, তা-ও সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম।
শত শত মানুষ ছিল ট্রেনের ভেতর। ট্রেনটি যখন ডেনমার্কের সীমান্তে এসে থামল, বগির গেট গেল খুলে। তখনও আমাদের গায়ে ছিল বন্দিদের পোশাক। আমরা বাঁধহীন স্রোতের মতো বগি থেকে নেমে দিগ্বিদিক দৌড়াচ্ছিলাম। জীর্ণশীর্ণ, ক্ষুধার্ত শরীরের শেষশক্তি দিয়ে লাফাচ্ছিলাম। পাগলের মতো চিৎকার করছিলাম। কেউ আমার একটি জিনিস কেড়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছিল। তার পেছনে ছুটেছিলাম। ধস্তাধস্তি করে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম আমার জিনিস। সবাই যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। স্বাভাবিক বোধহীন আমরা কোনো কিছুতেই বিব্রত হচ্ছিলাম না।
মনে আছে, ট্রেনটি পৌঁছেছিল খুব ভোরে। আমি দৌড়াচ্ছিলাম একটি পথ ধরে। এক ঘরের সামনে গোয়ালার রেখে যাওয়া এক বোতল দুধ দেখে তা তুলে নিয়ে এক চুমুকে খেয়ে ফেলেছিলাম। অন্য দরজার সামনে থেকেও কী কী যেন নিয়েছিলাম, ঠিক মনে করতে পারছি না। এগুলো নিতে লজ্জাবোধ হয়নি। বন্দিশিবিরে আমাদের বোধশক্তি হত্যা করা হয়েছিল, যেন আমরা দেহের ওপর চামড়া জড়ানো একেকটি মমিতে পরিণত হয়েছিলাম। সুস্থ মাথায় মুক্তির স্বাদ বোঝার শক্তি সেদিন ছিল না। কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, একটি নতুন ভোর, একটি নতুন পৃথিবী—সূর্য উঠছে।