এক ডজন গ্রামের ভরসা নিয়ে ছুটে চলেছে এই যুবতী
আলিপুরদুয়ারের কালচিনি ব্লকের বক্সা পাহাড়ে প্রায় ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বক্সাদুয়ার ডাকঘর। শ্রীজানা ছাড়া এই ডাকঘরে দ্বিতীয় কোনও কর্মী নেই। তাই সব কাজের দায়িত্বই তার উপরে।শ্রীজানার কথায়, পায়ে হেঁটেই সব জায়গায় যেতে হয়। কী করব, গাড়ি তো নেই। এক একটা গ্রামে যাওয়ার জন্য তো সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরি। সেদিন পোস্ট অফিস বন্ধই রাখতে থাকে।
এলাকার সদর বাজার, তাসিগাঁও, লেপচাখা, চুনাভাটি, লাল বাঙ্গলা, আদমা, ফুলবাড়ি, সেওগাঁওয়ের মতো গ্রামগুলিতে পায়ে হেঁটে চিঠি, মানি অর্ডার বিলি করেন শ্রীজানা। ঝড় হোক বা বৃষ্টি, অথবা ধস- সব ধরনের প্রতিকূলতা সামলেই জরুরি এই পরিসেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই যুবতী।
তবে শুধু কি ঝড়, বৃষ্টি? যাতায়াতের পথে মানুষ ছাড়াও অনেকের সঙ্গেই দেখা হয় শ্রীজানার। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘বর্ষায় অনেক সময়ই পায়ে জোঁক কামড়ায়, সাপের উপদ্রবও রয়েছে। কিন্তু কোনো উপায় তো নেই!’ এমন ঝুঁকির কাজ করতে ভয় লাগে না? জবাবে কোনও কথা নয়, হেসেই যা বোঝানোর বুঝিয়ে দেন এই ব্রাঞ্চ পোস্ট মাস্টার।
কেন এমন ঝুঁকির চাকরি নিলেন? ইংরেজ আমলে এই এলাকার বাসিন্দা বাটা ডুকপা, তার ছেলে ছিড়িং ডুকপা এখানে রানারের কাজ করেছেন। ছিড়িং ৩৯ বছর ধরে এই পেশায় ছিলেন। দুইজনেই প্রয়াত হয়েছেন। ছিড়িংয়ের ছেলে পাশাং ডুকপা ৬ মাস কাজ করার পরে শ্রীজানা থাপার বাবা পুষ্পরাজ থাপা এই পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার হিসেবে নিযুক্ত হন। বাবার মৃত্যুর পরে ২০১১ সালের এপ্রিল মাস থেকে কালিম্পঙ সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক শ্রীজানা থাপা এই পদে চাকরি পান।
উত্তরবঙ্গের দুর্গম বক্সাদুয়ারে আজও ইংরেজ আমলের প্রথানুযায়ী ‘রানার’-রা চিঠি বিলি করেন। দেড় হাজার ফুট উচ্চতার থেকে সাড়ে চার হাজারর ফুট উচ্চতার একাধিক গ্রামে বক্সাদুয়ার ডাকঘরের ব্রাঞ্চ পোস্ট মাস্টার শ্রীজানা থাপা নিজেই রানার হয়ে চিঠি বিলি করেন। বক্সা দুর্গের কাছেই এই ডাকঘরটি অবস্থিত।
শ্রীজানার কথায়, আর পাঁচটা ডাকঘরের থেকে এই ডাকঘরটি অনেকটাই আলাদা। তার বক্তব্য, ‘বিদ্যুৎ নেই, গাড়ি নেই সমস্যা অনেক। বিশেষত বর্ষার সময় কাজ করা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
শ্রীজানা আরো বলেন, দুর্গম বক্সাদুয়ারে আজও ইন্টারনেট পরিষেবা বলে কিছুই নেই। বিএসএনএলের মোবাইল পরিসেবা থাকলেও মানুষ এখনো চিঠি লেখায় অভ্যস্ত। এমনকী, ব্যাংক অনেক দূরে হওয়ার কারণে অধিকাংশ গ্রামবাসী এখনো মানি অর্ডারের উপরে নির্ভর করে থাকেন। তাছাড়া ১০০ দিনের কাজের মজুরিও এই ডাকঘর থেকেই বিলি হয়।
বক্সা ডাকঘরের জন্য আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়াতে ডাক আসে। সেখান থেকে বাইকে বা অটোতে করে চিঠিসহ অন্যান্য জরুরি জিনিস প্রথমে সান্তালবাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসেন শ্রীজানা। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের উপরে ডাকঘরে পৌঁছন তিনি। প্রতি মঙ্গলবার হাট বারে স্থানীয় বাসিন্দারা ডাকঘরে এসে চিঠি নিয়ে যান।
তবে দুরবর্তী গ্রামগুলির বাড়িগুলির চিঠি বা মানি অর্ডার পৌঁছে দেওয়ার জন্য শ্রীজানাকে সপ্তাহে ২ দিন রানারের কাজ করতে হয়। বর্ষার সময়ে বক্সা পাহাড়ের পিছল রাস্তায় হেঁটে ডাক বিলি করা যে কতটা কষ্টকর, তা একমাত্র শ্রীজানাই জানেন।
এই ডাকঘরে কোনো ফোন নেই। নিজের মোবাইল ফোনই একমাত্র ভরসা। সকালে ডাকঘর নিজেই খোলেন শ্রীজানা, নিজেই ঝাড়ু দেন।
কোচবিহার জেলা ডাক বিভাগের সিনিয়র সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পোস্টাল বিভাগ থেকেই আলিপুরদুয়ারের ডাক পরিসেবা নিয়ন্ত্রিত হয়।
কোচবিহার ডিভিশনের সিনিয়র সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পোস্টাল সার্ভিস হরেকৃষ্ণ সাহা জানান, বক্সার মতো দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় শ্রীজানার মতো একজন যুবতী যে দায়িত্ব পালন করছেন, তা আমাদের কাছে গর্বের বিষয়। তবে এই সব দুর্গম এলাকার ডাক পরিসেবার জন্য স্থানীয় লোকেদের প্রাধান্য দিলে ভালো হয়। বক্সা ডাকঘরে শ্রীজানার জন্য একজন সহায়ক রাখার চিন্তা ভাবনা চলছে।