জুয়ার আড্ডা সাগরতলে
আমেরিকা লাস ভেগাস কিংবা স্পেনের ইবিজা। ফ্রান্সের সেন্ট ত্রোপেজ কিংবা ভারত মহাসাগরের মালদ্বীপ। আজকের বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের আমোদ-ফুর্তি আর মদ-জুয়ার আড্ডাখানা।
কিন্তু জাঁকজমক আর আভিজাত্যের দিক দিয়ে প্রাচীন শহরটির কাছে নিতান্তই তুচ্ছ আধুনিককালের এই শহরগুলো।
শহরটিতে একসময় আনন্দ-ফুর্তি আর রঙ্গ-রসে মজে থাকতেন ইতিহাস বিখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাতরা। ভূমধ্যসাগরের পারে বায়া নামের এই শহরটি এক সময় রাতদিন মানুষের পদচারণায় মুখর থাকত।
কিন্তু রোমানদের মদ-জুয়ার সেই আড্ডাখানার ধ্বংসাবশেষ আজ ইতালির পশ্চিম উপকূলে সাগরের জলের নিচে নির্জন ও নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছে।
প্রায় দুই হাজার বছর আগে রোমান সম্রাটদের হাত ধরে গড়ে ওঠে এই শহর। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ছিল এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির সময়। সেই সময়ে এটা ছিল ধনী ও অভিজাতদের ছুটি কাটানোর সেরা স্থান।
শুধু রোম সাম্রাজ্যই নয়, সারা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের মানুষই (বেশির ভাগই পুরুষ) সময় কাটাতে আসত এই শহরে। ঐতিহাসিকদের মতে, মার্বেল পাথরে বাঁধানো এর সুরম্য অট্টালিকা, মোজাইক করা উন্মুক্ত স্নানাগার সীমাহীন বিলাসিতার সমার্থক।
শহরটিতে প্রাচীনকালে কবি ও সেনাপতিসহ সবার যাতায়াতও ছিল বায়ায়। মহান বক্তা সিসেরো উপসাগর থেকে পশ্চাদপসারণের সময় এখানে বসে তার বক্তৃতা রচনা করেন। কবি ওয়ার্জিল ও প্রকৃতিবিদ প্লিনি গণস্নানের এ স্থানটিকে বসবাসের জন্য বেছে নেন তাদের আয়ু বাড়াতে।
এ ব্যাপারে মার্কিন ইউনিভার্সিটি অব অরেগনের ডিপার্টমেন্ট অব ক্লাসিকসের সহকারী অধ্যাপক কেভিন ডাইকাস দ্য ডেইলি বিস্টকে বলেন, ‘বায়া এমন একটা শহর ছিল যা সারা পৃথিবীর ধনীদেরকেই আকর্ষণ করত। এখানে এসে তারা যা খুশি তাই করতে পারত।’
কিন্তু সময়ের আবর্তে শহরটি ধীরে ধীরে সাগরের পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে। অনতি দূরের ক্যাম্পি ফ্লেগ্রেই আগ্নেয়গিরি উপকূল বরাবর অন্তত ৪০০ মিটার এলাকা ধসে পড়ে। এর ফলে জলের নিচে হারিয়ে যায় পুরো শহর। এরপর বহুদিন ধরে শহরটির কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।
প্রায় ১৭০০ বছর পর সম্প্রতি আজকের ইতালির পশ্চিশে গাল্ফ অব নেপলস তথা নেপলস উপসাগরের উপকূলের কাছেই শহরটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় ডুবুরিরা। বর্তমানে এটাকে ‘রোন সম্রাটদের ডুবন্ত নগর’ বলে ডাকা হয়।
ডুবুরিদের ক্যামেরায় ধারণ করা শহরটির বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন ছবি ও ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ১৭০০ বছর ধরে পানির নিচে ডুবে থাকলেও শহরের বেশিরভাগ অংশ ও বহু স্থাপনাই আনকোরা ও অক্ষত ছিল।
আগ্নেয়গিরির উদগিরণ আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস সত্ত্বেও এর রাস্তাঘাট, প্রাচীন, অট্টালিকার মেঝের মোজাইক এমনকি মূর্তি ও ভাস্কর্যগুলো এখনও আগের মতোই রয়েছে, যা এখন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থানের বেশিরভাগই রয়েছে জলের ৪ থেকে ৬ মিটার গভীরে। কোনো জায়গার গভীরতা ১০ মিটার। চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে এটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। থ্রি-ডি স্ক্যানিং প্রযুক্তি ও সামুদ্রিক পুরাতত্ত্বের অন্যান্য অগ্রগতি শহরটির বিস্তারিত জানতে সহায়তা করে।
২০০২ সালে জলের নিচের ১৭৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া তথা সংরক্ষিত সমুদ্র অঞ্চল ঘোষণা করা হয়।