ঘুরে আসুন বিদেশের এই বাংলার গ্রাম, রূপ-রস-সৌন্দর্য মাখানো স্বর্গে
প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনেই চোখে পড়ে হাঁস মুরগির খাবার খাওয়ার দৃশ্যপ্রদেশটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধান চাষ করা হয়। অনেকটা চলনবিলের মতো খেতের পাশে চলাচলের জন্য আল রয়েছে। ধানের খড়কুটো রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। রাস্তাগুলো প্যাচপ্যাচে কাদায় একেবারে মাখামাখি। দূরের কোনো মাঠে চোখে পড়বে গরুর ঘাস খাওয়ার দৃশ্য। অনেকখানি দূরত্বে চোখে পড়বে ছোট্ট ছোট্ট ভিলা বা বাগানবাড়ি। প্রতিটি বাগানবাড়িতেই রয়েছে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল আর কমলা, জয়তুন, আখরোট ও আনার সহ হরেকরকম গাছগাছালি। সকালে ঘুম ভাঙবে চড়ুইপাখির কিচিরমিচির শব্দ ও মোরগের উচ্চ স্বরে! মোরগেরা সব পাল্লা দিয়ে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ডেকে ওঠে।
মাছের ছবি তোলায় ব্যস্ত কথাসাহিত্যিক শাকিব সবুরমেঠো পথ ছেড়ে একটুখানি শহরের দিকে পা বাড়ালেই চোখে পড়বে পুঁটি, রয়না, মহাশোল ও চাপিলাসহ হরেকরকম মাছের সঙ্গে শুঁটকি মাছের বাজার। মূলত ফুমানের বাজারে এই সব মাছের দেখা যায়। হুমায়ূন আহমেদের গৌরীপুর জংশনের ফারসি অনুবাদক কথাসাহিত্যিক ড. আব্দুস সবুর খান (ছদ্মনাম শাকিব সবুর) মাছের ডিম কেনার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু রান্না আর বহনের ঝামেলায় কিনলাম না। রাস্তায় রাস্তায় মাছ বিক্রেতা ফেরিওয়ালাদেরও চোখে পড়ে। এ ছাড়া রুদবারের বড় বড় দোকানগুলোতেও বিক্রির জন্য সারি সারি মাছ সাজানো রয়েছে।
হাঁসের ছানাগুলো জমিতে জমে থাকা জলের মধ্যে ডানা ঝাপটিয়ে স্নানে মেতে ওঠে। শাকিব সবুর গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জুতোগুলো প্রায় সাড়ে তিন বছর পর কর্দমাক্ত হলো। কারণ পাথুরে পাহাড়, মরুভূমি আর বরফে ঢাকা ইরানের কর্দমাক্ত পথে হাঁটার সৌভাগ্য এখনো হয়ে ওঠেনি।
কর্দমাক্ত মেঠো পথ চলে গেছে দূর থেকে দূরেএই প্রদেশের বৈশিষ্ট্য হলো গ্রীষ্মকাল ছাড়া বাকি তিনটি ঋতুতেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আমরা শীতকালের একেবারে মাঝামাঝি সময়ে দেখতে পেলাম পুরো গিলান প্রদেশ জুড়ে মেঘে ঢাকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা রাতে যে বাড়িতে ছিলাম সেখানে পুরোপুরি গ্রামীণ বাংলার শীতকালের পরিবেশ খুঁজে পেলাম। দেশি মুরগি ও হাঁসের ডিম দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। রাতে ঘুমাতে গিয়ে লেপ-কাঁথার কথা মনে পড়ে গেল। পাগুলো কিছুতেই যেন গরম হচ্ছিল না! একটি শোফাজ (রুম গরম করার যন্ত্র) কাজ করলেও শীতের তীব্রতা মেনে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। জানালা দিয়ে বাইরের মাইনাস এক (-১) তাপমাত্রা টের পাচ্ছিলাম। সারা রাত টিপটিপ বৃষ্টির শব্দে দারুণ একটি রোমাঞ্চিত রাত অতিবাহিত করলাম। বাড়িগুলোর ছাদ রংবেরঙের টিনের চাল দিয়ে তৈরি। বাথরুমটি ঘরের বাইরে থাকায় ঠান্ডার ভয়ে যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। বাথরুমে গরম পানির ব্যবস্থা না থাকায় আরও বেশি বিপদে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে চুলায় গরম পানি করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলাম।
উল্লেখ্য, গিলান প্রদেশটি ধান, চা ও জয়তুন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে বিখ্যাত মসুলে গ্রাম, যা ১০০৬ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। ১৮০টি পরিবার এখানে বসবাস করে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি বাড়ির ছাদ ওপরের তলার বাড়ির উঠোন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আলবোরজ পর্বতমালার কোলে গ্রামটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১০৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ১৯৭৫ সালের ২১ আগস্ট ইরানের জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে গ্রামটিকে ইরানের জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করা হয়। ইউনেসকো কর্তৃক মসুলে গ্রামকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করার পর এখানে যাবতীয় নতুন স্থাপনা একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সবুজে ঘেরা পাহাড়ি কোলে মসুলে গ্রামে মেঘের ভেলাএ ছাড়া প্রদেশটিতে দেখার মতো রয়েছে রুদখানের দুর্গ, বন্দর আঞ্জালি, গিলান বাঁধ, শয়তানের গুহা, মারলিক টিলা, ড. মইনের সমাধি, সেফিদ রুদ (নদী), শাহ রুদ (নদী), তিতি সরাইখানা, খালাসকু হ্রদ ও লাহিজানের বিখ্যাত চা বাগান।
লেখক সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান।