ইংল্যান্ডের ইতিহাসের এরকম নৃশংস কলংক আর নেই !
কলকাতা টাইমস :
উনিশ শতকের মাঝামাঝি। পৃথিবীতে সাম্রাজ্য বাড়াতে মরিয়া ব্রিটেন। এদিকে তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও খুব একটা সুবিধের নয়। ইংল্যান্ডে হু হু করে ঢুকছে আইরিশ অনুপ্রবেশকারী। জার-শাসিত রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপ থেকে আসছে ইহুদিরা। বাড়তি জনসংখ্যার জন্য নষ্ট হতে বসেছে রাজধানী লন্ডনের ভারসাম্য। শহরের পূর্ব অংশে হোয়াইট চ্যাপেল এলাকাই ছিল এই উদ্বাস্তুদের মাথা গোঁজার প্রধান জায়গা। পড়ন্ত অর্থনৈতিক অবস্থার জেরে বহু মহিলা বাধ্য হন যৌন পেশায় পা রাখতে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিলেন এই বাস্তুহারা অনুপ্রবেশকারী। ফলে বাড়তে থাকে দেহপসারিণীর সংখ্যা। ১৮৮৮র অক্টোবরে লন্ডনের Metropolitan Police Service বলছে Whitechapel এলাকায় মোট ৬২টি ব্রোথেলে কাজ করতেন ১২০০ জন যৌনকর্মী।
ঠিক এই সামাজিক অবস্থায় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দেখা দেয় নতুন বিপদ। পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসে এক দুর্ধর্ষ নৃশংস খুনির উপদ্রপ। যার নাম হয়ে যায় Jack the Ripper। আসল নাম? কেউ জানে না। কেউ দেখেনি তাকে কেমন দেখতে। কিন্তু এমনভাবে সে খুন করত তার নামকরণ হয়ে যায় দ্য রিপার। কারণ ধারালো অস্ত্র দিয়ে সে ফালা ফালা করে দিত মহিলাদের দেহ।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে জ্যাক বেছে নিত যৌনকর্মীদের। ১৮৮৮র ৩ এপ্রিল থেকে ১৮৯১ এর ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্জন্ত ১১ জন মহিলাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয় হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায়। একসঙ্গে এদের বলা হয় white chapel murders। তারমধ্যে পাঁচজন দেহপসারিণীকে খুন করা হুবহু এক কায়দায়। এদের বলা হয় canonical five। গলা এবং তলপেটে গভীর ক্ষত, যৌনাঙ্গ ফালাফালা করে দেওয়া এবং ছিন্ন শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে বিভিন্ন অঙ্গ সরিয়ে ফেলাই ছিল জ্যাকের মোডাস অপারেন্ডি।
এই পাঁচ শিকারের মধ্যে প্রথম ছিলেন মেরি অ্যান নিকোল। ১৮৮৮র ৩১ মে শেষ রাতে তার দেহ মেলে বাকস রো-তে। এখন এই রাস্তার নাম Durward Street। মেরির গলা ধারাল অস্ত্র দিয়ে দুই টুকরো করা ছিল। পেট এবং তলপেট প্রায় কুচি কুচি করে ফেলা হয়েছিল তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে।
দুই সপ্তাহ পরে খুন হন অ্যানি চ্যাপম্যান। ৮ সেপ্টেম্বর পাওয়া গেল তার নিথর দেহ। হ্যানবেরি স্ট্রিটে। মেরির মতো অ্যানেরও গলা আর তলপেটে ধারাল ছুরির অতল ক্ষত। শরীর থেকে বের করে নেওয়া হয়েছিল ইউটেরাস।
দিন ২০-২২ পরে একসঙ্গে দুটো খুন। তখনকার বার্নার স্ত্রিট, আজকের হেনরিক স্ট্রিটে পড়েছিল এলিজাবেথ স্ট্রাইড এর দেহ। ঘাড়ের বাঁদিকে আর্টারিতে মোক্ষম আঘাত। তারও তলপেটে আছড়ে পড়েছিল একের পর এক শাণিত অস্ত্রের ছোবল।
এরপর এক নতুন আতঙ্ক। এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে পাওয়া গেল মেরি জেন কেলির ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ। লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে। আগের তিনজনের মতো এই যৌনকর্মীরও গলা আর তলপেট খণ্ডিত। শরীরে নেই ইউটেরাসের অনেকটা আর বাঁদিকের কিডনি।
এরপর মাসখানেকের নীরবতা। সবাই স্বস্তি পেল। বোধহয় বন্ধ হলো খুন। ভুল ভাঙল। আবার শিকার করল জ্যাক দ্য রিপার। এবার তার থাবা এড়াতে পারল না ক্যাথরিন এডোজ। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যে পড়েছিলেন তিনি। মিলারস কোর্টে। গলাকে চিরে আঘাত চলে গিয়েছিল মেরুদণ্ড অবধি। আক্ষরিক অর্থেই মৃতদেহের পেট ছিল কার্যত ফাঁকা। প্রায় সব অঙ্গই বের করে নিয়ে গিয়েছিল খুনি। ছিল না হৃৎপিণ্ডটাও।
এই পাঁচজনের পরও হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় চলতে থাকে হত্যালীলা। বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার হয় যৌনকর্মীদের দেহ, বলা ভালো দেহের টুকরো। অনেক সময় পড়ে থাকত মুণ্ডহীন দেহ। কখনও হাত পা পড়ে থাকত এখানে ওখানে। কিন্তু এদের সঙ্গে রিপার জ্যাকের আদৌ সম্পর্ক আছে কি না জানতে পারেনি পুলিশ।
নৃশংস এই হত্যালীলার তদন্তে খামতি ছিল না। মেট্রোপলিটন পুলিশের CIDর বাঘা বাঘা অফিসাররা নেমেছিলেন তদন্তে। জেরা করা হয়েছিল দুই হাজরের বেশি জনকে। তদন্তের আতসকাচের তলায় ছিল ৩০০ জনের বেশি। আটক করা হয়েছিল ৮০ জনকে।
বন্দিদের তালিকায় কে ছিল না! বিশেষ করে আটক করা হয়েছিল কসাই আর ডাক্তারদের। কারণ মৃতদেহে আঘাত আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরিয়ে নেওয়ার নিপুণ কায়দা দেখে মনে হয়েছিল অ্যানাটমি নিয়ে সম্যক ধারণা আছে খুনির। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। অধরাই থেকে গেছে আসল অপরাধী; গোটা দুনিয়া যাকে চেনে জ্যাক দ্য রিপার নামে।
আশ্চর্যজনক ভাবে; জ্যাক শিকার করত সপ্তাহান্তের রাতে। অনেকের ধারণা কসাই টসাই নয়। সে ছিল কোনো অভিজাত বংশের সম্ভ্রান্ত পুরুষ। কিন্তু হাজারো তত্ত্ব-আলোচনার পরও স্পষ্ট হয়নি তার পরিবার। মেলেনি তার অস্তিত্ব নিয়ে সামান্যতম হদিসও।
ইংল্যান্ডের ইতিহাসে জ্যাক দ্য রিপারের মতো কলঙ্কজনক অধ্যায় খুব কমই আছে। আর্থ সামাজিক দিক দিয়েও এর ভূমিকা অসীম। এই ঘটনার হেরে পূর্ব লন্ডনের বস্তিগুলোর দুরবস্থা নিয়ে সোচ্চার হন শহরবাসী। ধীরে ধীরে এ নোংরা ঘিঞ্জি এলাকায় আসে উন্নয়নের আলো। আজ, এই এলাকা ভোল পাল্টে ফেলেছে। তবু বহু অদলবদলের পরও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে উনিশ শতকের কিছু বাড়ি। আর আছে রিপার জ্যাকের গল্প। রাতের অন্ধকারে ভেসে বেড়ায় হোয়াইট চ্যাপেলের বাতাসে।
শুধু ইংল্যান্ডে নয়। বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক আর ভয়ের সমার্থক হয়ে যায় জ্যাকের নাম। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গেমস, গান, নাটক, টি ভি অপেরা সর্বত্র ঘাতক জ্যাকের হাতের ছাপ।
এই সিরিয়াল খুনির সুবাদে নতুন মাত্রা আসে ক্রাইম রিপোর্টিংয়ে। বলা যায়, এই হত্যালীলার খবর প্রকাশ করতে করতে সাবালক হয় ক্রাইম জার্নালিজম। বাদ থাকেনি ইংরেজি শব্দভাণ্ডারও। Jack the Ripper এর নাম থেকে জন্ম নেয় Ripperology, Ripperana, Ripperologist আর Ripper Notes। ক্রমে এরা একে একে জায়গা করে নিতে থাকে অভিধানেও।
BBCর History পত্রিকায় জ্যাক দ্য রিপার নির্বাচিত হয়েছে ইতিহাসের সবথেকে কুখ্যাত ব্রিটিশ বা Worst Briton হিসেবে। ২০০৬ সালে এই পত্রিকার পাঠকরা এই রায় দেন।
পৃথিবীর বহু অধরা রহস্যর মধ্যে জ্যাক দ্য রিপার অন্যতম। চিরকাল অন্ধকারেই ঢাকা রয়ে গেছে এর মুখ। জানা যায়নি যৌনকর্মীদের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে কী সুখ পেত এই বিকৃত-কামী?
শুধু রয়ে গেছে তার নাম। অপরাধ-খুন-হত্যা-রক্ত-অন্ধকারের সমার্থক হয়ে।