সাফল্য – অহঙ্কার ও অবধারিত পতনের গল্প – রজত
।। ‘ আসিরিয়া ধুলো আজ / ব্যাবিলন ছাই হয়ে গেছে ‘ ।।
অর্ধশতাব্দী ধরাতলে জীবনধারায় যুগপৎ ধেরিয়ে বা ধরাশায়ী হয়ে প্রকৃতির রাজ্যের ধারাবিবরণীর এ এক ধার্মিক প্রচেষ্টা ধরতে পারেন, তবে ঐ যে বলে যাবৎ বাঁচি, তাবৎ দেখি; যাবৎ দেখি, তাবৎ শিখি ।
80 র দশকের আমরা যারা মাধ্যমিক, তারা এই যুগ-সন্ধিক্ষণের সাক্ষী । তখন TV মানে দূরদর্শন, মোবাইল আসেনি, Internet ভাবনার বাইরে, radio তে গান শুনি আর HMV র একচ্ছত্র সাম্রাজ্য ।
গান যে মানুষের প্রাণের টান, বোঝা যায় পালাগান, কবির লড়াই, বাউল ইত্যাদিতে (উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জগৎ পৃথক) । হিন্দি সিনেমার তিন দিকপাল রফি মুকেশ কিশোর মারা যেতেই যে শূন্যতা তৈরি হল সুরকাররা অভিজিৎ-মুন্না-নীতিন কে দিয়ে চেষ্টা চালালেন বটে তবে দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে । এদিকে HMV পুরানো সিনেমার গানও সব বাজারে আনে না ।
গন্ধ পেলেন গুলশন কুমার । T-series (আমরা বলতাম theft series) শানু – বাবলা – অনুরাধাদের দিয়ে সব পুরনো গানের remake করালেন । অনেক সস্তায় অনেক গান । বিশুদ্ধবাদীরা নাক কুঁচকালেও সাধারণ মানুষের প্রয়োজন মিটল, খুব চলল সেসব । নাম সব ‘… কি ইয়াদে ‘।
পয়সা হতেই গুলশন সিনেমা produce শুরু করলেন । ‘মীরা কা মোহন’, ‘জিনা তেরি গলি মে’ জাতীয় সিনেমা এলো । নতুন নতুন নায়ক নায়িকা, নতুন নতুন সুরকার ( বাবুল বোস কে মনে আছে ?), common চরিত্র গায়িকা অনুরাধা পড়োয়াল । মীরা কা মোহনে সুরকার অনুরাধার স্বামী অরুণ, ‘রব য্যায়সা রূপ তুমহারা …’, নায়ক অবিনাশ। আমার সদ্য বিবাহিতা এক মাসি পুরো ফিদা । হ্যা, যা দেখতে, গানটা পুরো ফিট । তা, অরুণকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি । নিন্দুকে নানা কথা বলে ।
এদিকে মিঠুন গোবিন্দা বাপি লাহিড়ী একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে । পঞ্চমের গান মনে লাগছে না । নাসির হোসেন নয়া প্রজন্মকে ছেড়ে দিলেন, তার পরিবার থেকে উঠে এল আমির খান । গানের জগতে দাড়িয়ে গেল উদিত নারায়ণ, অলকা আর সুরকার দ্বয় আনন্দ – মিলিন্দ ( কয়ামৎ সে …)
যারা যা বোঝার বুঝলেন । বুঝলেন নতুন যুগ-সন্ধিক্ষণের মুখে মানুষ । ‘সারাংশ ‘ খ্যাত মহেশ ভাট আর গুলশন পরিচালক -প্রযোজক হলেন । গায়ক গায়িকা T- series এর শানু – অনুরাধা। সুরকার নবীন জুটি নাদিম শ্রাবণ ।
‘ আশীকি ‘ মানুষকে পাগল করে দিল । সিনেমা তেমন না চললেও বাকি সবাই এক ধাক্কায় বিশ্ব বিখ্যাত । পরপর মহেশ ভাটের সিনেমা আর নাদিম-শ্রাবণ এবং শানু ।
সাফল্য মাথা খারাপ করে দিল অনেককেই। প্রথম অনুরাধার। শানু তার থেকে বেশি বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে, এটা নিতে পারলেন না । ‘ দিল হ্যায় কে মানতা নেহি’- র ক্যাসেট বাজারে আসার পর একটা বাদে সব গান শানুকে বাদ দিয়ে আবার record করা হল । বাবলা মেহতা । সিনেমাতেও তারই গান । নাদিম-শ্রাবণ তখন অন্যান্য প্রযোজকের সিনেমায় অনুরাধাকে বাদ দিয়ে অলকাকে নিলেন । অনুরাধা ডুবলেন, ডুবলেন গুলশনও । বাকি জীবনটা ভজন গেয়ে কাটালেন ।
এরপরে মাথাটি গেল কুমার শানুর । একচ্ছত্র সাম্রাজ্য বজায় রাখার শিক্ষা ছিল না । অহঙ্কারী হলেন । প্রকৃতি আড়ালে হাসলেন । নাদিম-শ্রাবণ এর ‘ সাত রং কি স্বপ্নে’ -র recording এ ঝগড়া করে আদ্দেক গেয়ে studio থেকে চলে গেলেন । চরম অপমানিত নাদিম লোক পাঠালেন, যেখান থেকে পারো শানু কন্ঠী ধরে আনো । বম্বে তে তখন অনেকেই ঘোরাঘুরি করছে । বাবুল সুপ্রিয় বাকি অর্ধেক ও অন্য গানগুলি গাইলেন । বম্বে তে শানু বয়কট শুরু হল ।
বম্বে সিনেমা জগতের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ তখন মাফিয়াদের হাতে । নাদিমকে কেউ চটাল না । এবার তার মাথাটি গেল । গুলশন কুমার হত্যা মামলায় তিনি আজও অভিযুক্ত ও পলাতক ।
শানু এখন বাংলায় reality show করেন আর মহেশ ভাট কন্যার প্রশংসা ।
অসম্ভব প্রতিভাশালী কিছু মানুষ যুগ-সন্ধিক্ষণে অসম্ভব ( কিশোর – রাহুলদেব – লতা আশার যুগে এঁরা সুযোগ পেতেন না বোধ করি ) বিখ্যাত হয়ে এই যে নিজেদের একেকজন ঈশ্বর ভেবে বসলেন, সব কিছুই তাদের অঙ্গুলি হেলনে চালাতে চাইলেন এখানেই হল মুশকিল ।
প্রকৃতির রাজ্যে আমরা নিয়ন্ত্রক নই, এটা ভুলে না গেলে হয়তো তারা টিকে থাকতেন, আর আমরাও ভালো কিছু গান পেতে পারতাম হয়তো ।
যখনই নিজের বা আশেপাশে কারও আচরণে অহঙ্কারের প্রকাশ ঘটতে দেখি, মনে পড়ে যায় এইসব মানুষদের কথা । শিখি ঘটনা থেকে । ভুল করি, আবার শিখি । আবার আবার ….চরৈবতি ।।