১৯৭২, ১৪ এপ্রিল: ‘পাগাড়া’ সেদিন সেলিব্রেটি ডাকাতদের হলিউডি মঞ্চ !
আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ২)
সৌগত রায়বর্মন:
তিন প্রখ্যাত বা কুখ্যাত ডাকাত যখন রাজি হয়ে গেছে তখন অন্যান্যরাও হবে। কিন্তু কার কাছে আত্মসমর্পণ করবে তারা?
নিশ্চই পুলিশ বা প্রশাসন নয়, কোনও আমলা বা মন্ত্রীর কাছেও নয়। ডাকাতদের একটাই দাবি, তারা স্যারেন্ডার করবে একমাত্র জয়প্রকাশের সামনে।
তিনি কথা দিলে তবেই শুরু হবে সমর্পণ পর্ব। চিঠি চালাচালি শুরু হল। একদিকে জেপি অন্যদিকে মাধো, মোহর। মাঝখানে তহশিলদার সিং।
অবশেষে দিন-ক্ষণ ঠিক হল। ১১ এপ্রিল ১৯৭২ সাল। গোয়ালিয়রের কাছে ‘পাগাড়া’ গ্রামে, রাতের অন্ধকারে ডাকবাংলোর কাছে এসে দাঁড়াল জেপির সাদা জিপ গাড়ি। সঙ্গে কোনও পুলিশের গাড়ি নেই। ডাকবাংলোর কাছেই তাঁদের হাইড আউটে লুকিয়েছিল মাধো, মোহর, নাথু ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা। জেপির গাড়ি এসে থামতেই একে একে বেরিয়ে এল মাধো, মোহর, নাথু ও অন্যান্যরা। ডাকবাংলোর জানালা দরজা মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল।
শুরু হল ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা। মাধো একটু বেশি স্মার্ট। সে কিছু শর্ত চাপানোর চেষ্টা করেছিল। তাই শুনে গর্জন করে উঠেছিল জেপি, ‘কোনও শর্ত নয়। অপরাধীদের তরফ থেকে আমি কোনও শর্ত শুনব না। তবে হ্যাঁ, তোমাদের যেন ফাঁসির আদেশ না দেওয়া হয় তার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব। দরকারে আমরণ অনশন করব। কিন্তু তোমাদের বিচার হবে জেলের ভিতরে। গারদে থাকতে হবে না। হাতে হাতকড়ি পরানো হবে না। শারীরিক নির্যাতনের কোনও প্রশ্নই নেই, কেননা তোমরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করনি। তোমাদের মামলা চলবে জেলের ভিতরে বিশেষ আদালতে। তোমাদের বাসস্থান হবে মুঙ্গাওয়ালির খোলা জেল।’
সহমত হওয়া গেল। ডাকাত সর্দাররা জেপির পায়ে প্রনাম করে একে একে বিদায় নিল। বলে গেল, আগামীকালই তারা তাঁদের মত জানিয়ে যাবে।
জেপির চোখে তখন জল।
১২ এপ্রিল দূত মারফৎ ডাকাতদের কাছ থেকে খবর এল তারা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে রাজি আছে তবে তা জয়প্রকাশ নারায়ণের সামনে। অন্য কারোর সামনে তারা অস্ত্রসমর্পণ করবে না।
এত বড় একটা খবর তো চাপা থাকে না। দেশে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ল জয়প্রকাশের করিশমা । এক সঙ্গে ১০০ জন ডাকাত স্যারেন্ডার করবে, পৃথিবীতে এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। তাও একটি মাত্র মানুষের কাছে। কিন্তু কোথায় হবে এই সমর্পণ যজ্ঞ? পাগাড়াতে নয়, হবে কাছেই জৌরা গ্রামে।
পাগাড়তে তখন বাগী উৎসব। জেপির তখন কাজের শেষ নেই। সরকারি টালবাহানার পর শেষ পর্যন্ত সরকার রাজি হয়েছে এই আত্মসমর্পণ পর্বে। দিন ঠিক হল ১৪ এপ্রিল। দেশ বিদেশ থেকে সাংবাদিকরা হাজির পাগাড়াতে। জৌরাতে সমর্পণ মঞ্চ। মধ্যপ্রদেশের দুটি ছোট্ট গ্রাম, জৌরা ও পাগাড়া তখন যেন খবরের রাজধানী।
পাগাড়া তখন সেলিব্রিটি ডাকাতদের হলিউডি মঞ্চ। বেহড় থেকে উঠে, কাধে টেলিস্কোপি রাইফেল নিয়ে ডাকাতরা ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। পুলিশ নির্বিকার। পুতুলের মত পাহারা দিচ্ছে বাগীদের। গ্রামবাসীরা মাধো ও মোহরের পিছন পিছন ঘুরছে। ভয় ডরের চিহ্নই নেই ওদের চোখে-মুখে। পুলিশকে যেন কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। পুলিশও চিত্রবত। তাঁদের একাংশের চোখে-মুখে রাগ যেন তপ্ত উনোনের মত টগবগ করে ফুটছে। বাকি অংশ হতাশ। তারা মনে মনে প্রার্থনা করছে, কোনও ডাকাত যেন স্যারেন্ডার না করে। মুখ উদাস করে কোনও কোনও পুলিশ অফিসার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হায়! প্রতি মাসে ডাকুদের দেওয়া মোটা টাকার মাসোহারা এবার বন্ধ হয়ে যাবে। সংসার চলবে কি করে? মাইনের টাকায় তো মাসে ১০ দিনের বাজার খরচের টাকাটাও উঠবে না।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা তথ্য হিসেবে জানিয়ে দেওয়া ভালো। চম্বল অঞ্চলে মাস প্রতি ৫ কোটি টাকা খরচ করা হতো পুলিশ বাহিনীর জন্য। অথচ সেই ডাকাতদের মাত্র কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে। বাকিরা সবাই আত্মসমর্পণ করেছে কোনও না কোনও সংস্থার কাছে। বিনোবা ভাবে এবং জয়প্রকাশ এমনই দুটি সংস্থার নাম। মানুষ তো বটেই। এই প্রতিবেদক ৩০ বছর আগের হিসেব দিতে পারবে, এখন সেই টাকার অঙ্ক কত তা জানা সম্ভব নয়।
এই সত্যের কথা আমরা শুনেছিলাম বুন্দেলখন্ড জঙ্গলে। আমরা তখন বাবা ঘনশ্যামকে খুঁজতে ঘটনাচক্রে এক রাত অ্যান্টি ডেকয়িটি ফোর্সের ক্যাম্পে ছিলাম। রাতে এই ব্যাটেলিয়নের মেজর খান সাহেবের সঙ্গে হালকা স্কচে চুমুক মারতে মারতে শুনেছিলাম আরে ভাইয়া ডাকু না থাকলে পুলিশের কী দরকার? আমরা তো বেকার হয়ে যাবো। এই যে শুকনো চিজ আর স্কচ খাচ্ছেন তা সরকারের পয়সায়। জঙ্গল ইন্সেন্টিভ। ডাকাত না থাকলে এটা হত?
১৯৭২ সাল। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তখন ইন্দিরা গান্ধীর বরপুত্র প্রকাশচন্দ্র শেঠী। আত্মসমর্পণ কাণ্ডে যার এতটুকু অবদান নেই উল্টে জয়প্রকাশকে প্রতি পদে পদে অপমান করে গেছেন তিনি, সেই তাকেই দেখা গেল পাগাড়া গ্রাম পরিদর্শনে। সেই তিনিই হাসি হাসি মুখে ডাকাতদের সঙ্গে ছবি তুলছেন দেদার। সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আজ এই পর্বের সব কৃতিত্ব তারই।উঁচু মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে এমনভাবে হাত নাড়লেন যেন তাকে দেখার জন্যই এত লোক আজ এখানে এসেছে।
১৪ এপ্রিল, জৌরা গ্রামে ঠিক সকাল ৯ টা। একে একে এল ডাকাতদের দল। জয়প্রকাশের নির্দেশে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির সামনে তারা তাঁদের অত্যাধুনিক বন্দুক সমর্পণ করল। সজল চোখে তারা প্রনাম করল জয়প্রকাশ এবং তার স্ত্রী প্রভাবতী দেবীকে। কিন্তু মাধো, মোহর, নাথু কোথায়? তারা তো এখনো এলো না। মাঠে এত লোক হয়েছিল যে ব্যারিকেড ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। রিল লাইফের অমিতাভ বচ্চন পর্যন্ত লজ্জা পেত রিয়েল লাইফের হিরোদের জনপ্রিয়তা দেখে।
ঘড়ির কাটা ঠিক ১০ টার ঘরে। লোকজন চিৎকার করছে মাধো মোহর কে দেখার জন্য। কী প্রবল সেই আকুতি। পুলিশের একাংশের মুখ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তারা ভেবেই নিয়েছে এলেবেলেরা এসেছে আত্মসমর্পণ করতে। রাঘব বোয়ালরা ভক্কি দিয়ে পালিয়ে গেছে।
মঞ্চে একমাত্র মানুস যার মুখে দুশ্চিন্তার কোনও চিহ্নই নেই। প্রবল আত্মবিশ্বাস। তিনি জেপি।
হঠাৎই দূর থেকে দেখা গেল ধুলো উড়িয়ে আসছে একটা জিপ গাড়ি। জনতা চিৎকার করে উঠল আনন্দে। ওই আসছে, ওই আসছে। কিন্তু কে আসছে? ধুলোর ঝড়ে বোঝা গেল না। ধীরে ধীরে ছবিটা পরিষ্কার হতে লাগল। জিপের পিছনে সার সার লোকের ভিড় । তার কাধের বন্দুকের নল প্রখর রোদের আলোয় চকচক করছে। ক্রমশ বোঝা গেল জিপের উপর দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং মাধো। পরনে মিলিটারি ফেটিগ। প্রতিক্ষমান জনতা মাধোর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।
জেপির চোখে জল। বিনোবা ভাবের অসম্পূর্ণ কাজ তিনি শেষ করলেন আজ।
মঞ্চে একে একে উঠল মাধো ও তার ৪০/৫০ জনের ডাকু আর্মি। গান্ধী মূর্তির সামনে তারা তাঁদের অস্ত্র নামিয়ে রেখে প্রনাম করল জয়প্রকাশকে। মাধো যেহেতু ভালো বক্তা তাই সামনের জন সমুদ্রের সামনে কান্না ভেজা গলায় সে পাব্লিক সাপোর্ট আদায় করে নিল। কিন্তু একটা কথা তো সত্য যে তার অক্লান্ত চেষ্টা না থাকলে এত আয়োজন বৃথা যেত।
মাধো তো হল কিন্তু মোহর, নাথু? তারা কোথায়? তারা আশে-পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে বাইনোকুলার দিয়ে নজর রাখছিল মঞ্চের দিকে। মাধোর কী দশা হয় তা দেখার জন্য। প্রায় আধ ঘন্টা পর এলো মোহর সিং। সঙ্গে বিরাট দলবল। মাধোর মতো সেও গান্ধী মূর্তি সামনে অস্ত্র রেখে জেপিকে প্রনাম করল।
পুলিশ ঢোক গেলার মতো ডাকাত বাহিনীকে উপহার স্বরূপ গ্রহন করে যার যার নির্দিষ্ট তাঁবুতে বসিয়ে দিল।
এই পর্বটি আমার আখো দেখা হাল নয়। ৭২ সালে আমি ক্লাস এইটে পড়ি। তাই আমায় সাহায়্য নিতে হয়েছে কিছু পুঁথির। বিশেষ করে তরুণ ভাদুরির। কিন্তু এই গল্পটির সবিস্তার কাহিনি আমারা শুনেছিলাম রছেড় গ্রামেই। আমাদের প্রথম অভিযানে । সেই দুধে কিছু জল মেশান ছিল। এখানে জল বাদ দিয়ে শুধু দুধটুকু পাঠকদের উপহার দেওয়া হল।
কিন্তু একটা প্রশ্ন সেদিন থেকে আজও চলছে আমায় ভাবায়, এই সমপর্পণই কি ডাকাতি সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়? বোধহয় তা সত্য নয়। তা হলে পরবর্তী সময়ে মালখান, ফুলন, রমেশ- এদের উদয় হয় কি করে? একমাত্র কারণ, ওরা সম্ভবত বুঝে গিয়েছিলো, ডাকাতিতে কোনও দোষ নাই।কয়েকদিনের হিরোগিরি। তারপর কোনও মন্ত্রী বা আমলার কাছে বিস্তর নাটক করে অস্ত্র বিসর্জন দেওয়া। বাকি জীবনের দায়িত্ব সরকারের। সম্প্রতি খবর পাওয়া গেছে বুন্দেলখন্ডের ডাকাতরা আবার তাঁদের পুরনো অবস্থানে ফিরে গেছে। সরকার নাকি তাঁদের কোনও কথা রাখেনি। তারা হয়তো আবার আত্মসমর্পণ করবে বছর দুয়েক বাদে। কেন চম্বলে এত ডাকাত পয়দা হয়, তার উত্তর সম্ভবত এই প্রশ্নের মধ্যেই আছে।