অবাক নীরবতায় ৩২ বছর দাঁড়িয়ে মৃত্যুর শহর

এখানে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, কেবল রেডিওএ্যাক্টিভ ট্যুরিজমের নেশায় পাগল কোনও অভিযাত্রী ট্যুরিষ্টদল মধ্যে মধ্যে হানা দিয়ে ফেরে। তাদের পরনে থাকে বিশেষ পোশাক – কোনও কিছুকে স্পর্শ করাও কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ, তাদের জন্যও। তারা দেখে, মেঘমুক্ত নীল আকাশের তলায় – ঝকঝকে সবুজ ঘাস, মাঠ দাপিয়ে ছুটে বেড়ানো বুনো ঘোড়ার দল, নদীতে ঝাঁপানো মাছ – গাছের পাতায় বৃষ্টির জল জমে আছে। এসব তাদের স্পর্শ করা বারণ – কারণ এসবেতেই যে নিঃশব্দে মিশে রয়েছে প্রজন্মের বিষ, বাসা বেঁধে আছে ক্যান্সারের মৃত্যুদূত। এ এক অদ্ভুত শহর, জীবন্মৃত স্মৃতিদেরকেই দুঃখ চেপে হাতড়ে খোঁজার শহর, চেরনোবিল। ৩২টা বছর কেটেছে।
১৯৮৬র এপ্রিলে, রাশিয়ার (বর্তমানে ইউক্রেন) চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রের বিস্ফোরণ – পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ শিল্প-বিপর্যয়। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল প্রকাশিত হতে বিস্তর সময় লেগে গিয়েছে। আজ সাংবাদিক-লেখক-ভুক্তভোগীরা প্রমাণ করতে পেরেছেন – সেই চেরনোবিল কেবল একটি সামান্য দুর্ঘটনা নয়, ইয়োরোপের একাধিক দেশের সমাজ-পরিবার-যোগাযোগ-আর্থসামাজি
২০১৫সালে নোবেল পুরষ্কারজয়ী সাহিত্যিক শ্বেতলানা এ্যালেক্সিভিচ ১৯৯৭সালের একটি লেখায় নির্দ্বিধায় তাই বলতে পেরেছিলেন, “চেরনোবিলের নাম শুনলেই সবাই ইউক্রেনের কথা বলে, তারা ভুলে যায় বেলারুশ বা বেলোরাশিয়ার কথাও – চেরনোবিলকে ঘিরেই গড়ে ওঠা বেলারুশের ইতিহাস তাই আজও লেখা বাকি, কেউ বা হয়তো কোনোদিন তা লিখবে বলেই আশা নিয়ে বেঁচে থাকি।” বেলারুশ অর্থে বেলোরাশিয়া বা ‘হোয়াইট রাশিয়া’ – তথ্যগত ভাবেই চেরনোবিল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।
চেরনোবিলে পরমাণু-বোমা পড়েনি, কেবল পরমাণু-বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী একটি কেন্দ্রের মূল রিএ্যাক্টরটি বিক্রিয়া চলাকালীন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় – ফলস্বরূপ রেডিওএ্যাক্টিভ ফল-আউট ঘটে – অর্থাৎ তেজস্ক্রিয় কণা বা বিকিরণ পরিবেশে ছড়িয়ে যায়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিলো যে – আকাশের বায়ুমণ্ডলেও সেই বিকিরণ এবং তেজস্ক্রিয় কণা গিয়ে মেশে – এবং, কিছু দিনের ব্যবধানেই, আবহাওয়াগত কারণে তা সারা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়েই বয়ে বেড়ায় – ঠিকই শুনেছেন, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়েই এর বিস্তার ঘটে, বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন ভারতবর্ষ এমনকি আফ্রিকার বায়ুমন্ডলেও চেরনোবিলের ঘটনার কিছু সপ্তাহ পরে পরেই অস্বাভাবিক মাত্রায় তেজস্ক্রিয় কণার অস্তিত্ব মিলতে পেরেছিলো। তবে, বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো প্রতিবেশী দেশগুলিই। উদাহরণ দেবার চেষ্টা করা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ আগুনে বেলারুশের ৬১৯টি গ্রাম জার্মান সেনার হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো, চেরনোবিলের কারণে বেলারুশের ৪৮৫টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ৭০টি গ্রামের মাটি ভয়ানক ভাবে তেজস্ক্রিয়তার লক্ষণ দেখানোয় – তাদেরকে চিরদিনকার মতোই ৪ থেকে ৬ফুট মাটির নীচে বুজিয়ে ফেলা হয়। এটাও ঠিকই শুনেছেন – মানুষ নয়, ৭০টি আস্ত গ্রামকে সে সময়ে মাটির গভীরে বুজিয়ে ফেলা হয়েছিলো যুদ্ধকালীন তৎপরতায়, পৃথিবীর অজান্তেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেলারুশের জনসংখ্যার প্রতি ৪জনের ১জন নিহত হয়েছিলেন, চেরনোবিলের তেজস্ক্রিয়তায় আজ বেলারুশীয়দের প্রতি ৫জনের ১জনকে তেজস্ক্রিয় অঞ্চলে – তেজস্ক্রিয়তাকে বরণ করে নিয়েই বাঁচতে হয় – প্রতি ৫জনের ১জন অর্থে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ (৭ লক্ষ শিশু সমেত)।
বেলারুশের গোমেল এবং মোগিয়ালভ প্রদেশে জন্মের চেয়ে মৃত্যুর হার ২০% বেশী। দেশটির ২৩% জমিই তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত। নদীর জলে বিকিরণ মিশে বেড়ায় – সোনালী মাছেরা অভক্ষণীয় – তাদের শরীরেও মিশেছে বিষ। মস্তকহীন শিশুরা জন্ম নিয়েছে, আতঙ্কের প্রহর গুণতে গুনতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠতে চেয়েছেন নতুন মায়েরা সবাই। ক্যান্সার সেখানে রোজকার খবর, ভয় বা বিস্ময়ের অবকাশ নেই কোথাও। চেরনোবিলের আগে , প্রতি ১লক্ষ বেলারুশীয়ের ৮২জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হতেন – এখন সংখ্যাটা ৬০০০ ছাড়িয়ে যায় – নীট বৃদ্ধির হার প্রায় ৭৪গুণ।
সামাজিক অবক্ষয়ের খবর শুনবেন – তৎকালীন সোভিয়েত সরকার খবরটিকে চেপে রাখতে এতটাই তৎপর ছিলেন, যে দুর্ঘটনার ১সপ্তাহেরও কম সময়ের ভিতরেই – দেশের অন্যান্য গ্রাম ও শহর থেকে শিশুদেরকে জুটিয়ে এনে চেরনোবিলে মে দিবসের মিছিলে হাঁটানো হয়। তাদের ক্যান্সার হয়েছিলো। ‘স্বেচ্ছাসেবক’দের ‘উদ্বুদ্ধ’ করে তুলে, সামান্যতম নিরাপত্তা ছাড়াই তাদেরকে চেরনোবিলের দুর্ঘটনাস্থলের নির্বিষকরণের কাজে নামিয়ে দেওয়া হয় – সেখানে মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে কোনও বৈদ্যুতিন যন্ত্র বা রোবটই আর কাজ করতে পারছিলো না কোনোভাবেই। বিভিন্ন সময়ে তাদের মৃত্যু বা অসুস্থতার যে সমস্ত বর্ণনা পড়বার সুযোগ পেতে পেরেছি – সেসব এখানে লেখাও আমার পক্ষে কষ্টকর, কুৎসিত বীভৎসার এমনই চরম রূপ দেখেছিলো চেরনোবিল। বিজ্ঞানীদের উপর সোভিয়েত সরকার নজরদারী বসায়, যাতে করে কেউ কোনও বেফাঁস মন্তব্য কোথাও করে না বসেন। সমাজতাত্ত্বিকেরাও তাই সোভিয়েত ভেঙ্গে যাবার কারণগুলির মধ্যেও আজকাল চেরনোবিলের অবদান দেখেন।
এসব কথাই বা কেন লিখছি আজ? আপনারা আমাকে প্রোপাগান্ডিস্ট বলতে পারেন। ৫ইজুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পৃথিবী জুড়ে আরও নানা ইস্যুর সঙ্গে সঙ্গেই, পরমাণু-চুল্লি বা পরমাণু বিদ্যুতের বিরোধিতায় একাধিক সংগঠন আওয়াজ তুলতে চাইবে। চেরনোবিলের সঙ্গে সঙ্গেই তারা মনে করিয়ে দিতে চাইবে ২০১১সালের ফুকুশিমা পরমাণু-কেন্দ্রের সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কথাও। ১৯৮৬র চেরনোবিলে মানুষের ভুলেই পরমাণু কেন্দ্রের চুল্লিতে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিলো, ২০১১র ফুকুশিমায় সেই একই দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সুনামির জলোচ্ছ্বাস। যে কোনও পরমাণু-চুল্লিরই সম্পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ার অর্থই হলো তাই ‘মূর্খের স্বর্গে অধিষ্ঠান’। আর সেসমস্ত দুর্ঘটনার ফলশ্রুতির খতিয়ান যে ঠিক কেমনটাই বা হতে পারে তা তো এই গত কয়েকটি অনুচ্ছেদেই বিস্তারিত বলে এলাম।
সরকার আপনাকে জানাবে না কিছুই, কারণ পরমাণু-বিষয়ক সব খবরই যে রাষ্ট্রীয়-নিরাপত্তার লালফিতেতেই বন্দী পড়ে থাকে চিরটাকাল। নিঃশব্দে আপনার চারপাশের সবকিছুই, বিষাক্ত হয়ে পড়বে সকলের অজান্তেই। ফুকুশিমার যে চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটেছিলো – তার কেন্দ্রস্থলে আজ অবধিও কোনও রোবট বা যন্ত্রও পৌঁছিয়ে উঠতে পারেনি। চেরনোবিলের সেই ইতিহাসই যেন এই ৩২টা বছরেই নতুন হয়ে ফিরে আসতে পেরেছে আরেকবার।