৭৯. ঝারখন্ড আন্দোলন (পর্ব ১)
[kodex_post_like_buttons]
এ এক উত্তাল সময়। ৩২ বছর পার হয়ে গেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীন দেশের বঞ্চিত, অবহেলিত এক শ্রেণীর আদিবাসী মানুষ গোপনে তাঁদের অস্ত্রে শান দিতে শুরু করলো। রাষ্ট্রের কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতে চাইলো তাদের হিসেবে নিকেশ। শুরু হলো ‘ঝাড়খন্ড মুভমেন্ট’। গোপনে সেই আন্দোলনকে সমর্থন জানালো শহুরে শিক্ষিত কিছু মানুষ। বাদ গেলো না কলকাতাও। সেই আন্দোলনের একটা অংশ খুব কাছ থেকে দেখে ফেলে তখনকার ‘অ-সাংবাদিক’ সৌগত রায়বর্মন।
সৌগত রায় বর্মন:
সাল ১৯৭৯। আমার বয়েস ২২। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজ তখন আমার যৌবন বাউল। সকাল দশটায় চেয়ার দখল করি, বন্ধু খুঁজি। তারপর ম্যারাথন আড্ডা। সন্ধের কফি হাউস তখন মাতিয়ে রেখেছে কবি শক্তি চাটুজ্যে, তাঁকে ঘিরে তুযার রায়, বিনয় মজুমদার এবং নতুন প্রজন্মের কবি রণজিত দাস, নিশিথ ভড়, জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্তরা। দেখতাম আর অভিমানে ঠোঁট ফুলে যেত। কবে ওদের দলে জায়গা পাবো?
এরকমই এক অভিমান মাখা সন্ধায় দেখি আমাদের টেবিলের দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছেন আমার বন্ধু বাপী। পরবর্তিকালে প্রখ্যাত লোক সংগীত শিল্পী স্বপন বসু ।আমরা সমবয়েসী এবং কিশোর বয়েস থেকে এক সঙ্গেই বড় হয়েছি। স্বপন আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, তোকেই খুঁজছিলাম।
আমি? কেন, আমি তো দোতারা বাজাতে পারি না। স্বপন হো: হো: করে হেসে উঠল, বলল, ওটা যে তোর কম্ম নয় জানি। আমি দিনে কুড়ি ঘন্টা প্র্যাক্টিস করি, সেটা সম্ভবত তুই জানিস না। যাই হোক আমি তোকে মোটেই খুঁজছি না। খুঁজছেন এই ভদ্রলোক সোমনাথ চক্রবর্তি। আমার বন্ধু। নৃতত্ববিদ । পিএইচডি করছেন। মনে রাখিস, আমি তোর রেফারেন্স দিয়েছি বলেই উনি তোর খোঁজ করছেন।
ভদ্রলোক আমার বয়েসের দিকে খেয়াল করে একটু কুন্ঠিত স্বরে বললেন, তুমি ছবি তোলো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কি ক্যামেরা ইউজ করো?
এবার আমার রেগে যাওয়ার পালা। আমি শালা কোন ক্যামেরায় ছবি তুলি? আমার ডার্করুম কোথায়, তা জেনে তোর কী? কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। দাঁত কেলিয়ে বললাম জেনিথ।
সোমনাথবাবু স্বস্তির হাসি হেসে বললেন, যাক বাঁচা গেল। খুব একটা দামি নয়। আরেকটা কিনে নেওয়া যাবে।
আমি ততক্ষনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। স্বপন আমার হাঁত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? উনি তোকে যুদ্ধে পাঠাচ্ছেন, একটু বাজিয়ে নেবেন না?
যুদ্ধ করতে যাবো আমি? আমি থতমত খেয়ে বসেই পড়লাম। মুখে অনন্ত জিজ্ঞাসা।
সোমনাথবাবু এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন
স্বপনের কাছ থেকে শুনলাম, তুমি নাকি রাজনীতি সচেতন? তা ঝাড়খন্ড আন্দোলনের নাম শুনেছো?
এবার আমার পালা। আমি সোমনাথের মুখের দিকে এমন ভাবে তাকালাম যেন আইন্সটাইনকে পিতা পূত্রের বয়সের অংক জিজ্ঞাসা করেছে। আমার মুখের ভাব দেখে উনি তা আন্দাজ করে বলে উঠলেন, আরে জানি জানি, তুমি জানো। আচ্ছা বলত, এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য কি?
খুব সিম্পল। পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র, মহারাস্ট্রের কিছু আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে একটা পৃথক রাজ্য, যেখানে ভূমিপূত্ররাই ক্ষমতার আসনে বসবে। ইতিহাস মতে এই রকম একটা রাজ্যের কল্পনা করেছিলেন শ্রী চৈতন্যদেব।
মনে হল সোমনাথবাবু প্রীত হয়েছেন। মুখে বললেন, বাহ! তুমি তো অনেকটাই জানো। তোমার বয়েস কম, কিন্তু কাজে যখন নেমেই পড়েছো চ্যালেঞ্জ তো নিতেই হবে। যাবে নাকি এই আন্দোলন কভার করতে? মূল লেখাটা আমি লিখবো। ছবি তোমার। অভিজ্ঞতা তোমার। আমি উত্তেজনায় ফুটতে ফুটতে জিজ্ঞেস করলাম,
কোথায় যেতে হবে?
উনি বললেন, প্রথমে ঝাড়গ্রাম। সেখানে থেকে কেষ্টপুর। দেখা করতে হবে যামিনী মাহতোর সঙ্গে । তারপর কোথায় যেতে হবে কি করতে হবে তা ওই বলে দেবে।
কবে যেতে পারবে?
আমার চোখে তখন ধমসা, মাদল, সড়কি, বল্লমের ফলা। সোমনাথের দিকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডে অব দ্য জ্যাকেলের এডোয়ার্ড ফক্সের মত বলে উঠলাম
হোয়াই নট কাল?
তাই শুরু হল?
৭৯ সালের মে মাসের তপ্তদুপুর। প্রবল দাবদাহ মাথায় নিয়ে নামলাম ঝাড়গ্রামে । পুঁজি বলতে মায়ের কাছ থেকে নেওয়া অপরিশোধ্য ধার একশো টাকা। গোটা কুরি ফিল্মের রোল, ঝোলান ব্যাগে একটা জামা একটা প্যান্ট।
ঝাড়গ্রাম থেকে কেষ্টপুর বাসে দাঁড়ানোর জায়গা পাইনি ঠিকই, তবে বসার ব্যবস্থা হয়েছিল, ছাদে। বৈশাখের রোদে মাথায় গামছা বেধে কী ভাবে যে এক সময় কেষ্টপুর পৌঁছে গেলাম, সে বিস্ময় আমার এখন কাটেনি। তবে ঘন্টা চারেক লেগেছিল।
কেষ্টপুর বলে যখন একটা ভুগোল পাওয়া গেছে তখন যামিনী মাহাতো নামের একটা ইতিহাসও পাওয়া যাবে।বাস স্ট্যন্ডে নেমেই দেখলাম চায়ের দোকান। আহা যেন অমৃত অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সঙ্গে আবার চপ, তেলেভাজা, বেগুনি। এক ধামা মুরি, আর গোটা দশেক তেলেভাজা খেয়ে মনটা দিওয়ানা হয়ে গেল। দোকানি স্বস্নেহে জিজ্ঞেশ করলেন, কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে বুঝি? কার বাড়ি? আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বললাম, যামিনী মাহাতোর বাড়ি। দোকানি একটু ভেবে উত্তর দিলেন, যামিনী মাহাতো? মানে ঝাড়খন্ড পার্টির? সে তো এখান থেকে দু ক্রোশ হাঁটতে হবে। যামিনী এখন নেই। সদরে গেছে। ফেরার টাইম হয়ে গেছে। এখানেই নামবে। তুমি বরং একটু অপেক্ষা কর।
বলতে বলতেই একটা বাস এসে দাঁড়াল। ঝাড়গ্রাম থেকে বেলপাহাড়ী যাচ্ছে। বাস থেকে নেমে এল ঠিক আমারই বয়েসী একটা ছেলে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। দোকানি যামিনীকে বললেন, এই ছেলেটি কলকাতা থেকে এসেছে তোমার খোঁজে। ধরে প্রাণ এলো। যামিনী মাহাতো বলে তাহলে সত্যিই একটা রক্ত মাংসের মানুয আছে! যাক মনে হচ্ছে কাজটা হবে।
আমি ব্যাগ থেকে সোমনাথের চিঠি বার করে দিলাম। পরন্ত সন্ধ্যের আলোয় যামিনী চিঠিটা খুব মন দিয়ে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সোমনাথ দা পাঠিয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। যামিনী হাসতে হাসতে বলল, ঝাড়খন্ড আন্দোলন কভার করা খুব সহজ কাজ নয়। যাইহোক তুমি সাইকেল চালাতে পারো তো ? আমি মাথা নাড়লাম, পারি। যামিনী বলল, মাইলের পর মাইলি কিন্তু সাইকেলে যেতে হবে। পারবে তো? আমি বললাম, না পারলে হেঁটেও মেরে দিতে পারি।
যামিনী হো: হো: করে হেসে উঠল। বলল, বাহ, বেশ বেশ। এখন আমার ঘরে চল। দু ক্রোশ কিন্তু হেঁটে যেতে হবে।
স্বপন আর সোমনাথের মুখ মনে পড়ল। তাদের ধন্যবাদ। জার্নালিস্ট হবার প্রথম পথচলা তাহলে সত্যিই শুরু হল?