৭৯. ঝারখন্ড আন্দোলন (পর্ব ২)
[kodex_post_like_buttons]
শুরু হল নতুন সিরিজ আই উইটনেস
এ এক উত্তাল সময়। ৩২ বছর পার হয়ে গেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীন দেশের বঞ্চিত, অবহেলিত এক শ্রেণীর আদিবাসী মানুষ গোপনে তাঁদের অস্ত্রে শান দিতে শুরু করলো। রাষ্ট্রের কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতে চাইলো তাদের হিসেবে নিকেশ। শুরু হলো ‘ঝাড়খন্ড মুভমেন্ট’। গোপনে সেই আন্দোলনকে সমর্থন জানালো শহুরে শিক্ষিত কিছু মানুষ। বাদ গেলো না কলকাতাও। সেই আন্দোলনের একটা অংশ খুব কাছ থেকে দেখে ফেলে তখনকার ‘অ-সাংবাদিক’ সৌগত রায়বর্মন।
গভীর রাত পর্যন্ত চলল ঝাড়খন্ড আন্দোলন নিয়ে যামিনীর এক তরফা বক্তৃতা। আমি কিন্তু মনে মনে ছক কষেই চলেছি কাল কোথা থেকে শুরু হবে আমার কাজ।
ঢেকি ছাটা চাল, আলু সেদ্ধ আর দেশী মুরগীর ঝোল খেতে খেতে অস্থির হয়ে এক সময় জিজ্ঞেশ করলাম, কাল আমরা কোথায় যাচ্ছি?
যামিনী মুখ না তুলেই উত্তর দিল, কাঁকড়াঝোর। ওখানে একটা মিটিং আছে। এখন ঘুমিয়ে পড়। কাল ভোর পাঁচটায় সাইকেলে রওয়ানা হতে হবে।
সে এক অলৌকিক যাত্রা। গভীর শালের জংগল। অজস্র ছোট ছোট শাখা নদী, খাল, বিল, কখনো এক হাঁটু জল আর মাঝে মাঝে কয়েক ঘর আদিবাসী গ্রাম। গ্রামের সকলের কাছেই খুব পরিচিত মুখ যামিনী মাহাতো। ও তাদের সঙ্গে কখনো কুর্মালি, কখনো সাঁওতালি ভাযায় জরুরী কথাবার্তা সেরে নিল। কিছুটা বুঝলাম, কিছু অবোধ্য থেকে গেল। ক্যামেরা বার করে আমি পটাপট আমার প্রথম দেখা আদিবাসীদের ছবি তুলতে লাগলাম। মাটি লেপা এত নিটোল গার্হ্যস্ত আগে কখনো দেখিনি। উঠোন জুড়ে মূরগী বা কাঁকড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝকঝকে কাঁসার গেলাসে জল খেতে দিল। সে শুদ্ধ জলের স্বাদ এখনো আলজিভে লেগে আছে। আদিবাসী জীবনের সারল্য, আলস্য ও উদাসীনতা ওদের গার্হ্যস্ত দেখলেই বোঝা যায়। ঘরের মরদকে নাম জিজ্ঞেশ করতে উত্তর এল, নিতাই মুর্মু। ঝাড়খন্ড আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখটা ধক করে উঠল। সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা সম্ভবত ও জানে।
ঘন্টা তিনেক সাইকেল চালিয়ে পৌঁছানো গেল কাঁকড়াঝোর। দেখলাম সব শুনশান। কেউ কোত্থাও নেই। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে যামিনী হাসল। বলল, একটু অপেক্ষা কর , সব দেখতে পাবে।
খুব বেশিক্ষণ না, বড়জোর মিনিট পনের। দূর থেকে শোনা গেল গুম গুম শব্দ । ধমসা মাদলের। তারপর দশদিক থেকে। যেন সওয়াল- জবাব চলছে। ছোটবেলায় অরন্যদেব পড়তে গিয়ে বুঝেছিলাম আফ্রিকান ড্রাম পিটিয়ে কিভাবে খবরের আদান প্রদান হয়। এখানে চাক্ষুশ করলাম। চারিদিকের জঙ্গল যেন জেগে উঠল। ধীরে ধীরে সেই আওয়াজ যেন চলতে শুরু করল। এগিয়ে আসতে লাগল। যামিনীর চোখে মুখে বিজয় গর্বের হাসি। কিছুক্ষন বিস্ময় বিমূঢ় অবস্থায় বিলীন থেকে চোখে পড়ল মাথায় সবুজ ফেট্টি, প্রস্তাবিত ঝড়খন্ডের প্রকৃত মালিকরা নাচতে নাচতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রখর রৌদ্রজ্জ্বল তাদের বল্লম সড়কিগুলির ফলা চকচক করছে। শুধু একদিক থেকে নয়, জঙ্গলের দশদিক থেকেই ছোট ছোট দলে ওরা আসছে। একেকটা দলে জনা কুরি মানুয। প্রতি দলে একটা জয়ঢাক, ধমসা, মাদল, শিংগা। কুচকুচে কালো শরীরের পেশীগুলি যেন তালে তালে নাচ্ছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে শুরু হল আমার প্রথম এয়াসাইনমেন্টের রেডি-স্টেডি-গো। ঘন সবুজ জঙ্গলকে ক্যানভাস করে কালো কালো শরীরগুলিকে ফ্রেমে ধরা। দুপুরের চড়া রোদে মানুযগুলিকে যেন আরো কঠিন মনে হচ্ছিল। এরাই সেই বুনো মানুয যারা যুগ যুগ ধরে দেশের এই বিস্তীর্ণ জঙ্গলকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করেছে, রক্ষা করেছে, হায় তারাই আজ প্রান্তিক। শিকারজীবীরাই ক্রমে ক্রমে শিকারে পরিনত হয়েছে সভ্যতার।
যারা এই জমায়েতে এসেছে তারা যে শুধু সাঁওতাল তা নয়। আছে খেরিয়া, লোধা, শবর, ওঁড়াও, মুন্ডা। যার যার ভাসা আলাদা, কিন্তু কুর্মালি বা মাহাতোদের ভাষা সবাই বোঝে।
জঙ্গলের ফাঁক-ফোকর দিয়ে একটা লম্বা ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল।যামিনীকে সে কথা বলায় সে বলল, আজ নয়। আজ অস্ত্র নিয়ে মিছিল করলে এক্ষুনি পুলিশ আসবে। এই জমায়েতের খবর ওদের কাছে আছে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, ও ছবি তুমি পাবে। দুদিন অপেক্ষা করো।