৮০ বছর পর এই কারণে মানুষের বেঁচে থাকার সময় শেষ
৮০ বছর পর দক্ষিণ এশিয়ায় যে গরম পড়বে তা মানুষের বেঁচে থাকার সহ্যসীমা অতিক্রম করতে পারে। তাতে লাখ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে কিংবা এলাকাছাড়া হতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে ওই সময় আর্দ্রতার মাত্রা বেড়ে এমনটা ঘটবে। ওই সময় সারা বিশ্বেই এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার ৩০ শতাংশ মানুষের জন্য এ হুমকি প্রবল। বিশেষ করে ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল এবং বাংলাদেশের মানুষ এই ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্সের শিক্ষক ইয়ুন সুন ইমের নেতৃত্বে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এর প্রধান লেখক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) পরিবেশ প্রকৌশলের অধ্যাপক এলফাতিহ এলতাহিরিহ।
প্রতিবেদনে বল হয়, দুটি জলবায়ু মডেলের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়। এর একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ‘অপরিবর্তনযোগ্য পরিস্থিতি’। অন্যটি হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার পরিস্থিতি।
অর্থাৎ দুটি দিক বিবেচেনা করেই তাঁরা গবেষণাটি করেছেন। কারণ বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা নিয়ে ১৯০ জাতির প্যারিস জলবায়ু চুক্তি গড়ে উঠেছে, যাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এই গবেষণার মূল লক্ষ্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা নয়, মূলত ‘ওয়েব বাল্ব টেম্পারেচার’ বা আর্দ্রতাজনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টির ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা মোকাবেলায় মানবশরীর কী প্রতিক্রিয়া দেখায় সেই বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে চেয়েছেন। কারণ মানুষের শরীরের আর্দ্রতাজনিত তাপমাত্রার সর্বোচ্চ সীমা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সেখানে পৌঁছলে কী হতে পারে? সেটিই মূল আলোচনার বিষয়।
এই দিকটি সামনে রেখে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, যদি ‘অপরিবর্তনযোগ্য পরিস্থিতি’ তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে মানুষের বেঁচে থাকার সহ্যসীমা অতিক্রম করবে ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রা। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে পারলে এই পরিস্থিতি এড়ানো যাবে। তাঁদের মতে, এই শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ এশিয়ার ৩০ শতাংশ মানুষ এই ক্ষতিকর তাপমাত্রার কবলে পড়বে। তবে এই মুহূর্তে এই আশঙ্কা শূন্য। মূলত দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ শ্রমিকরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পলায়ন করার মতো সুযোগ খুব কমই পাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের অধিকাংশ আবহাওয়া অফিস দুই ধরনের থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয় করে। প্রথমটি হলো ‘ড্রাই বাল্ব’ থার্মোমিটার। এটি দিয়ে বাতাসের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। অন্যটি হলো ‘ওয়েট বাল্ব’ থার্মোমিটার, যা দিয়ে বাতাসে থাকা অপেক্ষাকৃত আর্দ্রতা মাপা হয়। এতে দেখা যায়, সাধারণত বাতাসের তাপমাত্রার তুলনায় আর্দ্রতার মাত্রা কম থাকে।
আর মানবজাতির জন্য এই ‘ওয়েট বাল্ব’ রিডিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষের শরীরের ভেতরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হলো ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শরীরের ত্বকের তাপমাত্রা থাকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে দেখা যায়, ত্বকের বাইরের তাপমাত্রা কম। এটি কম হওয়ার কারণ শরীরের ভেতরের ‘বিপাকক্রিয়াজনিত তাপ’ (মেটাবলিক হিট) ঘামের মাধ্যমে বাষ্প হয়ে বের হয়ে যায়। কিন্তু বাতাসে যদি ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার বা আর্দ্রতাজনিত তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর বেশি হয়ে যায়, তাহলে শরীর থেকে তাপ বের হওয়ার হার দ্রুত কমতে থাকবে। কারণ ত্বকের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতাজনিত তাপমাত্রা তখন সমপরিমাণ হয়ে যাবে। এমনটি ঘটলে ছয় ঘণ্টার মধ্যে একজন সুস্থ মানুষও মারা যেতে পারে, যেটিকে হিটস্ট্রোক বলে। এর কারণ আর্দ্রতাজনিত তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছার অর্থ হলো মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ সীমা। এ ছাড়া আর্দ্রতাজনিত তাপমাত্রার ক্ষেত্রে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসকেই বিপজ্জনক মাত্রা বলে মনে করা হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এ যাবৎকালে বিশ্বে তাপমাত্রার রেকর্ডের ইতিহাসে ওয়েট বাল্ব বা আর্দ্রতাজনিত তাপমাত্রার সীমা ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার ঘটনা খুবই বিরল। ২০১৫ সালে ইরানে তা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। আর ওই বছরের গ্রীষ্মকালে ভারত ও পাকিস্তানে তীব্র দাবদাহে সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কার্বন নিঃসরণের হার না কমানো হলে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে ওয়েট বাল্ব তাপমাত্রার সীমা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যেতে পারে। বিশেষ করে গঙ্গা অববাহিকা, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বাংলাদেশ, চীনের পূর্ব উপকূল, শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চল এবং পাকিস্তানের সিন্ধু অববাহিকায় ওয়েট বাল্বে তাপমাত্রার সীমা চরমে পৌঁছতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই আশঙ্কা দূর করতে হলে প্যারিস জলাবায়ু চুক্তি মেনে চলতে হবে, যাতে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ ২ ডিগ্রির নিচে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।