ফুলনের সঙ্গে দেখা করবো বলতেই গাইড যেভাবে আমাদের দিকে তাকালো…
আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ৮)
সৌগত রায়বর্মন: অবশেষে গোয়ালিওর । রাত দশটা নাগাদ পৌছালাম । টাঙ্গা নিলাম। রাতেও যে এরকম গরম বাতাস বইতে পারে তা জানতাম না। ভোপাল থেকে এই বাতাস প্রতিটি লোমকূপে অনুভব করতে করতে এসেছি এখানে। রাতের ল্যু জীবনে প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম গোয়ালিওরে এসে।
দিব্য আর আমি ঠিক করলাম, যত টকা লাগে লাগুক, একটা এসি ঘর আমাদের লাগবে। নইলে মৃত্যু নিশ্চিত। টাকা ফুরিয়ে গেলে হয় শহরে ভিক্ষে করব, নয় তো কোনও না কোনও ডাকাতের দলে ভিড়ে যাবো । ইতিমধ্যে বেশ কিছু ডাকাতের কন্ট্যাক্ট আমাদের হাতে আছে। দরকারে বাকি জীবনটা বেহড়ে কাটিয়ে দেবো। কিন্তু শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হোটেলের ঘর আমাদের লাগবেই। তখন এসি হোটেলের এত চল ছিলনা। যা ছিল তা এয়ার কুলার।জলের ভিতর ফ্যান ঘুরিয়ে বাতাসকে ঠান্ডা করার দামড়া মেশিন। সাধারণ ঘরের চাইতে ভাড়া অনেক বেশি।
ঘর তো পাওয়া গেল। হোটেলের ম্যানেজার সেই ঘরের দরজা খুলতেই আমরা যেন ২৫ হাজার ভোল্টের কারেন্ট খেয়ে ছিটকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। ম্যানেজারবাবু যথেষ্ট সপ্রতিভ ভাবে বললেন, আপনারা নিচে গিয়ে বসুন। আমি আধঘন্টার মধ্যে ঘরে জল ঢেলে মেশিন চালিয়ে ঠান্ডা করে দিচ্ছি। লোক না থাকলে তো আর শুধু শুধু মেশিন চালাই না।
সত্যিই তাই। ঘরের মেঝেতে জল ঢেলে মেশিন চালিয়ে দেওয়া হল। মেশিনের সে কী গর্জন! জেনারেটর না এয়ারকুলার তা বোঝা মুশকিল।
আধঘন্টার মধ্যে ঘর ঈষৎ ঠান্ডা হল। মানে ভোর রাতের দিকে হয়তো শীতও লাগতে পারে। যাইহোক আমরা রাতে রোটি আর আলু-ভর্তা খেয়ে নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়লাম।
আগামীকাল ফুলন, মালখান। দেখা হবে তো? না হবার কিছু নেই। আমাদের সঙ্গে তো বাঙালি আইজির পারমিশন লেটার আছে।
কাল দুপুর বারোটা। তখন কি বারবেলা পার হয়ে যাচ্ছে?
রীতিমত নিয়ম মেনে মনে মনে মা, বাবা আর সম্পাদককে স্মরণ করে পৌঁছে গেলাম গোয়ালিওয় জেলে। আমাদের খাতির করে ভিতরে ঢুকতে দিলেন জেলার সাহেব। স্বয়ং আইজির গেস্ট আমরা।
জেল চত্বরে ঢুকেই হকচকিয়ে গেলাম। এটা কারাগার নাকি আনন্দ আশ্রম? তীব্র গরমের মধ্যে যে যেখানে ছায়া পেয়েছে সেখানে দলবেধে গাল গল্প করছে। দেখেই মনে হল সব ব্যাটা ডাকাত। কারোর পরনে কয়েদির পোশাক নেই। যে যার মতো সাজুগুজু করে ফ্যাশন শো-এ হাজির। কারো মাথায় পাগড়ি, কারো বা এই গরমেও শেরওয়ানি। কেউ খৈনি টিপতে ব্যস্ত তো কেউ বা পান সাজতে।
আমাদের সঙ্গে জেলার সাহেব যাকে গাইড হিসেবে দিয়েছিলেন সে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ইয়ে সব লোক ডাকু থা। স্যারেন্ডার করকে অভি বহুত মস্তি মে হ্যায়।
সেটা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ফুলনের দেখা নাই। গাইডকে জিজ্ঞেস করতে বলল, দিদি শায়েদ ঘর মে হ্যায়। এখানে ঘর বলতে সেল বুঝে নিতে হবে। ডাকাতদের জন্য গোয়ালিয়র মুক্ত কারাগার।
আমরা ঠিক করলাম আগে মালখানের ঘরেই যাবো। ফুলনের পাশের সেল বা ঘরেই মালখান থাকে। ফুলনের সঙ্গে দেখা করব আমাদের মিশন ফুলনের একেবারে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে । গাইডের কাছ থেকে শুনলাম, প্রতিহিংসার জন্য ফুলন নাকি প্রথমে মালখনের কাছেই গিয়েছিল। ফুলন নিচু জাত বলে মালখন ফুলনকে না করে দিয়েছিল। মাঝে চরম শত্রুতায় পৌঁছেছিল দুজনের সম্পর্ক। হয়েছিল এনকাউন্টারও। সেই সাপ আর নেউল একই জেলের পাশাপাশি ঘরে?
আমাদের গাইডকে ফুলনের সঙ্গে দেখা করার কথা বলতে সে যেভাবে আমাদের দিকে তাকালো, মনে হল আমরা যেন দেবাদিদেব মহাদেবের জটার উকুন বেছে দেবার অনুরোধ করেছি। ডাকু মালোখানের নাম বলতেই সে যেন কেমন উদাস চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা তো অভি সো গায়া! নিন্দ ছুট জায়গা তো মুঝে মার দেগা ।
চম্বলে শান্তি রক্ষকদের সম্পর্কে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নেতিয়ে পড়ল।
এবার আমরা গম্ভীর গলায় বললাম, আইজি সাব আমাদের পাঠিয়েছে। তোমার দাদাকে গিয়ে বলো কলকাতা থেকে পত্রিকার লোকেরা এসেছে। দাদার ইন্টারভিউ নেবে।
গাইড বাবু কি বুঝল কে জানে। কনফিউজড অবস্থাতেই নিয়ে গেল মালখানের সেলে। বলল, দাদা কলকাতা সে পত্রিকাকে লোগ আয়ে। অন্দর ভেজ দু ?
ভিতর থেকে ঘুম জড়ানো গলায় উত্তর এলো, কেয়া বোলা? পত্রিকাকে লোগ ? আরে শালা উনকো জলদি অন্দর ভেজ।
বুঝলাম মাধ সিং এর মতন মালোখানও পাবলিসিটি পছন্দ করা বাগী।
অন্দর যানে কা বাদ যা দেখলাম তাতে উদোম আশ্চর্য হওয়া বললে কম বলা হয়। বরঞ্চ বলা ভালো আমরা বিস্ময়ে স্ট্যাচু হয়ে গেলাম।
এটা কি জেল খানা নাকি কোনো থ্রি-স্টার হোটেল? ঘরের তিন দিক থেকে তিনটে টেবিল ফ্যান বনবন করে ঘুরছে। দূরে একটা সদ্য কেনা এ্যারকুলারও আছে। বাইরে দগ্ধ দুপুর। ভিতরে উইন্টার।
মেঝেতে ইয়া মোটা গদিতে শুয়ে আছেন দা গ্রেট মালখান সিং।
আমাদের উদ্যেশে আইয়ে আইয়ে বলে উঠে বসলেন তিনি। খালি গা। টকটকে ফর্সা রং। অপূর্ব রূপবান। বসে থাকা অবস্থায় বুঝলাম উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট।
– ক্রমশ …..