কালো চশমা (গল্প)
[kodex_post_like_buttons]
অমৃতাভ বন্দোপাধ্যায়:
অফিস ছুটির পর ভবানীপুরে সৈফুলদার বাড়িতে বসে শনিবারের ভৌতিক পাতার লেখা বানাবার জন্য প্রস্তুত হ’তে, ভূত-চতুর্দশী,হ্যালোউইন সহ কলকাতার প্রাচীন নবীন ভূতেদের বিষয়ে জ্ঞান নিতে যেয়ে খেয়ালই করিনি যে-রাত এগারোটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে,একটা ট্যাক্সি ধরতে হা-ট্যাক্সি হা-ট্যাক্সি করে দাড়িয়ে রইলাম আরো অনেকক্ষণ। এমনিতেই ট্যাক্সি হল ইচ্ছেযান,যেদিকে যাবার দরকার আপনার,-সে যেতে চাইবে ঠিক তার উল্টোদিকে।আরনয় বলবে গ্যারাজ, নয় গাড়ি জমা করতে যাচ্ছে, ‘খানেকা টাইম ‘তো কমন বুলি।
এমনিতেই রাত অনেকটা হয়ে গেছে। যাকেই ডাকি, যাকেই হাত দেখাই,কেউ দাঁড়াতেই চায় না। অনেকক্ষণ ধরে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে ক্লান্ত লাগছে। আশাছেড়ে কিভাবে ফিরবো ভাবছি, হন্টন লাগাবো লাগাবো করছি ঠিক তখনই ঝরঝরে হলুদ ট্যাক্সিটাকে হাত দেখাতেই দাঁড়িয়ে গেল।আমি একটা কথাও না বলে পিছনের দরজা খুলে চেপে পড়লাম। কোথায় যাবো, ড্রাইভার সেখানে যেতে চায় কিনা কোন বলাবলির মধ্যেই যাই নি। আগে চেপে পরে কথা।যেতে না চাইলে আমিও গাড়ি থেকে নাববো না। আমি হাত পা এলিয়ে ড্রাইভারের দিকে চাইতে গিয়ে দেখি সেও আমার দিকে চেয়ে আছে। আশ্চর্য লাগলো ।লোকটার চোখে একটা কালো চশমা। ওই অত্ত রাতেও।লোকটার মাথায় পাগড়ি,মুখময় দাড়ি গোঁফ দেখে বোঝাগেল উনি পাঞ্জাবি। এবং বেশ তাগড়াই পাঞ্জাবি।কলকাতায় এখন আর অমন তাগড়া জোয়ান পাঞ্জাবি ড্রাইভার চেখে পড়ে না। লোকটার মাথা ঘোরানোটাও যেন কেমন লেগেছিল চোখে।স্টিয়ারিং ধরে কাঁধ না বাঁকিয়ে মাথাটা অতটা ঘুরিয়ে তাকানো যথেষ্ট অস্বাভাবিকতো বটেই ,কেমন যেন গা ছমছমে লেগেছিল।গাড়িতে উঠতে উঠতে লোকটার গা থেকে কড়া ন্যাপথলিনের গন্ধও নাকে পেয়েছিলাম।লোকটার কালো চশমার দিকে চেয়ে সবে বলতেগেছি-‘ভাইয়া আপ গোপাল -‘
লোকটা পরিস্কার বাংলায় বলে উঠেছিল ‘গোপাল নগর যাবেন তো?তাই যাচ্ছি, ফ্লাটের নাম মে-ফেয়ার, পচ্চিশ নম্বর ঘর’।
আমি চমকে গিয়েছিলাম,লোকটা গোয়ন্দা নাকি?না পুলিশ? পাগড়ী দাড়ি গোঁফ সব নকল নিশ্চয়ই। ছদ্মবেশে আমাদের ফ্লাটেরই কারো ওপর নজর রাখছে হয়ত।তা আমাদের ফ্লাটে দুচারজন অমন লোক আছে বল আমারও বিশ্বাস। বিশেষ করে আমার পাশের ফ্লাটের বজরিয়া ফ্যামিলির বাপ-বেটাতো হাইলি সাসপিশাস। সে রাখুক।কিন্তু আমার ঘরের নম্বর জানল কি করে ব্যাটা? নাকি আমার ওপরেই নজর রাখছে?কিন্তু কেন? আমিতো হেজিপেজি লোক।দৈনিক কাগজের অফিসের জুনিয়ার জার্নালিস্ট। আমার ওপর নজরদারি করতে গোয়ন্দা লাগাবে কে?আমার শ্বশুর মশাই? নতুন বিয়ে করেছি, তার মেয়ের ওপর কোন অত্যাচার জবরদস্তি হচ্ছে কিনা তাই টিকটিকি লাগিয়েছেন?রিটায়ার্ড মিলিটারি এরকমই হয়, নিজের গোঁফকে অবধি সন্দেহকরে।
আমি ভয়ে ভয়ে লোকটার দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করতে যাব, দেখি লোকটা এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। গাড়ি চলছে। চোখের কালো চশমাটা নেই। আর তার সেই খোলা চোখ দুটোয় না আছে চোখের মণি,না আছে চোখের পাতা।এক্কেবারে ধবধবে সাদা! ঝকঝক্ করছে!
ভয়ে আতঙ্কে আমি চিৎকার করে উঠে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম মনে আছে।
আর জ্ঞান হারাতে হরাতেও আমি স্পষ্ট শুনেছিলাম লোকটা হাঃ হাঃ,হাঃ হাঃকরে গলা ফাটিয় হাসছে।
পরে জ্ঞান ফিরে দেখি ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। বউকে জিজ্ঞাসা না করে পারিনি।‘হ্যাগো, ট্যাক্সি থেকে দোতলার ঘরে,আমার বিছানায় আনলে কে আমায়?
বউতো অবাক-
‘কেন? একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক,তোমার ট্যাক্সির ড্রাইভার! লোকটার গায়ে হেভি জোর মাইরি,তুমি আমায় মাঝেমাঝে যেভাবে চাগিয়ে বিছানায় তোল না?লোকটাও সেরকম একা চাগিয়ে দোতলায় এনেছে’!
‘লোকটার চোখে কালো চশমা ছিল’?
‘ভর রাত্তিরে কালো চশমা?তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে’?
‘তা হলে ওর চোখের মণি..’
রিম্পি আমার নতুন বউ, পাছে ভয় টয় পায়,তাই কালো চশমা-সাদা চোখ সব চেপে গেলাম। তাছাড়া রিম্পির এক্সমিলিটারি বাবাকে,তার গোঁফকে আমিই যথেষ্ট ভয় পাই! তার মেয়েকে ভয় দেখানোর কৈফিয়ত্ যদি চেয়ে বসে? তাই কথা না বাড়িয়ে রিম্পির শরীরী প্রশ্রয়ে বাথরুম যাবো বলে বিছানা ছেড়ে উঠতে গেছি, ঠিক তক্ষুনি বালিশের ধারে হাত লেগে ঠক্ করে মেঝেয় পড়ল একটা কালো চশমা।
আমার আর রিম্পির মাঝখানে।