শরীরে আঁচিল? ক্যানসার নয় তো?
কলকাতা টাইমস :
শরীরে টিউমারের মতো কী যেন একটা হয়েছে! ব্যথাহীন লাম্প থেকে ক্যানসার ছড়াচ্ছে না তো? সাতপাঁচ ভেবে আতঙ্কিত হবেন না৷ শরীরের কোনো অংশে টিউমারের মতো ফোলা মাংসপিণ্ড দেখা দিলেই আঁতকে ওঠার কিছু নেই৷ তেমনই অবহেলাও করবেন না৷ ফেলে রাখবেন না৷ চিকিৎসকের পরামর্শমতো পরীক্ষা করিয়ে রোগ শনাক্ত করুন৷
বেনাইন ও ম্যালিগন্যান্ট:
টিউমার দু’ধরনের হয়৷ বেনাইন এবং ম্যালিগন্যান্ট৷ অনেক সময় জন্ম থেকে অথবা ছোট বয়স থেকে শরীরের কোনো অঙ্গে বেনাইন টিউমার থাকে৷ এতে ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই৷ বেনাইন টিউমারে ক্যানসারের প্রবণতা থাকে না৷ এটি যে স্থানে হয় তার চারপাশের কোষ অথবা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে না৷ কিন্তু বেনাইন ক্যানসারও গুরুতর হতে পারে যদি সেটি শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে যেমন রক্তের কোষে অথবা স্নায়ুতে হয়ে থাকে৷ অনেক সময় আবার বেনাইন টিউমারের চিকিৎসারও দরকার হয় না৷ ম্যালিগন্যান্ট টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে সারিয়ে ফেলা যায়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একবার টিউমার বের করে দিলে পুনরায় তা ফিরে আসার সম্ভাবনা কম৷ ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকেই ক্যানসার হয়৷ এই ধরনের টিউমারগুলি ধীরে ধীরে তার চারপাশের কোষ এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে৷
টিউমার থেকে ক্যানসার বুঝবেন কীভাবে?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকেই ক্যানসার হয়৷ ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে কোষ বিভাজন হয়৷ টিউমারের আকৃতি বাড়তে দেখলে অবশ্যই ডাক্তারের মতামত নিন৷ কোনও জায়গায় চোট পেলেও অনেক সময় ফোলা বা কাটা জায়গা থেকে ক্যানসার হতে পারে৷ অনেক ধরনের ক্যানসার ত্বকের মাধ্যমে অনুভূত হয়৷ এই ক্যানসারগুলি প্রধানত স্তন, অণ্ডকোষ বা শুক্রাশয়, নিঃসারক গ্রন্থি এবং শরীরের নরম কলাগুলিতে বেশি দেখা যায়৷ টিউমার বা যে কোনও ধরনের ফোলা মাংসপিণ্ড ক্যানসারের প্রাথমিক অথবা শেষ পর্যায়ে হতে পারে৷ আপনি যদি এর আকার বাড়তে দেখেন তা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা করান৷ প্রাথমিকভাবে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে কোনও ব্যথা অনুভূত হয় না৷ ফলে ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের প্রাথমিক পর্যায়ে সেভাবে কোনও নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা না গেলেও কিছুদিনের মধ্যে ওজন হ্রাস, অ্যানিমিয়া ইত্যাদি লক্ষণ চোখে পড়ে৷ যতই সেই ক্যানসার আক্রান্ত টিউমারের আকৃতি বাড়তে থাকে, ততই তা আশপাশের স্নায়ু এবং পেশিগুলিতে চাপ দেয়৷ আর তখনই ব্যথা বা যন্ত্রণা অনুভূত হয়৷
ক্যানসারের উপসর্গ:
১) ফুসফুস ক্যানসার: শুকনো বা দীর্ঘদিনের কাশি, কাশতে কাশতে প্রায়ই কফের সঙ্গে রক্ত বেরনো, বুকে ব্যথা, ওজন হ্রাস, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ইত্যাদি৷
২) লিম্ফোমা ক্যানসার: লসিকার আকৃতি বৃদ্ধি, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস৷
৩) স্তন ক্যানসার: স্তনে টিউমার বা মাংসপিণ্ড, স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত নিঃসরণ, স্তন ও স্তনবৃন্তের আকার এবং ধরনের পরিবর্তন৷
৪) প্রস্টেট ক্যানসার: সাধারণভাবে প্রস্রাবে সমস্যা হলেও কখনো কখনো কোনো উপসর্গই বোঝা যায় না৷ তবে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়৷
৫) বোসাল সেল ক্যানসার: মূলত মুখ এবং গলার মতো যেসব অংশে সূর্যের আলো পড়ে এমন জায়গায় একটি সাদা টিউমার অথবা বাদামি রঙের ছোপ দাগ দেখা যায়৷
৬) মেলানোমা স্কিন ক্যানসার: শরীরের যে কোনও অংশে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অথবা শরীরের কোনো আঁচিলের আকারের পরিবর্তন৷
৭) কোলন ক্যানসার: এটি ক্যানসারের স্থান এবং আকৃতির উপর নির্ভর করে৷ সাধারণত মলত্যাগে সমস্যা, মলের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া এবং পেটে অস্বস্তি বোধ হওয়া৷
৮) লিউকিমিয়া: ধীর গতিতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই ক্যানসারের রোগীদের অনেক সময় কোনো উপসর্গ দেখতে পাওয়া যায় না৷ দ্রুত বৃদ্ধি পেলে দুর্বলতা, ওজন হ্রাস, সহজে রক্তক্ষরণ, মাথাব্যথা, ঘাম হওয়া, অনবরত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত হওয়া, নিশ্বাসে কষ্ট, ত্বকে লাল লাল ফুসকুড়ি ইত্যাদি৷
৯) এছাড়া ম্যালিগন্যান্ট টিউমার থেকে আরও বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হতে পারে৷ তবে সাধারণভাবে হঠাৎ করে খিদে কমে যাওয়া, ওজন হ্রাস, রক্তাল্পতা, মলের সঙ্গে রক্ত ইত্যাদি যে কোনও কিছু ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে৷ মহিলাদের ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাস থেকে জরায়ুর ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে৷ তাই এই ধরনের কোনো উপসর্গ শরীরে হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷
ব্রেস্ট ক্যানসার এড়াতে সতর্কতা:
প্রাথমিকভাবে রোগী তাঁর স্তনে আচমকাই টিউমারের মতো ফুলে ওঠা মাংসপিণ্ড অনুভব করেন৷ যা থেকে ধীরে ধীরে ব্যথা হয়, ফুসকুড়ি অথবা চুলকানির মতো সমস্যাও হতে পারে৷ তবে স্তনে সামান্য ফোলাভাব দেখলেই আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই৷ কারণ অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার না হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে৷
ডাক্তার কখন দেখাবেন:
১) স্তনে টিউমারের মতো ফোলা ভাব হলে৷
২) স্তনের ত্বক লাল হলে৷
৩) যে কোনো একটি স্তনবৃন্তের চারদিকে অথবা উপরে লাল লাল ফুসকুড়ি দেখা দিলে৷
৪) স্তনের একটি অংশ ভারী লাগলে৷
৫) যে কোনো একটি স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত নিঃসরণ হলে৷
৬) স্তনবৃন্তের ধরন ও আকার বা স্তনের আকারের পরিবর্তন হলে৷
ক্যানসার রোধের জন্য:
১) তামাক জাতীয় দ্রব্য বর্জন করুন৷
২) স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রা মেনে চলুন৷
৩) গ্রিন টি পান করুন৷
৪) খাদ্যতালিকায় পিঁয়াজ, রসুন রাখুন৷
৫) দীর্ঘদিনের সংরক্ষণ করে রাখা খাবার বর্জন করুন৷
৬) প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করবেন না৷
৭) নির্দিষ্ট বয়সে মহিলাদের এইচপিভি ভাইরাসের টীকা নেওয়া৷
৮) কোনো ধরনের অসুবিধা হলে প্রতি মাসে মহিলাদের নিয়মিত ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা উচিত৷
ক্যানসার নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা:
১) ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়৷ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে ক্যানসার সেরে যায়৷ এর জন্য সঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করতে হবে৷
২) ক্যানসার ৫% বংশগত৷ তাই অযথা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই৷
৩) ক্যানসারে অপারেশন করা উচিত নয়, এই ধারণা একেবারেই ভুল৷ বায়োপসি করলে ছড়িয়ে পড়ে, এমনটা ভাবাও ঠিক নয়৷ কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার নির্মূল করা সম্ভব৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ ভয় পেয়ে অনেকটা দেরি করে ফেলেন৷ ফলে ততদিনে ক্যানসারের আকারও বেড়ে যায় এবং পরিণতিতে এগিয়ে আসে মৃত্যু৷