মুসলমানের ‘ভূঁইয়া’ বংশ, হিন্দুদের ‘ভৌমিক’- কিন্তু ব্যাপারখানা কী?
অনেক দিন ধরেই
সুপ্রাচীন এই বংশের উৎপত্তি ও বিস্তৃতি নিয়ে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে। অনেকে যেমন মনে করেন, বারো ভূঁইয়াদের থেকে ভূঁইয়া বংশের সূত্রপাত। তবে এই ধারণার পেছনে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। মোগল সম্রাট আকবর তাঁর জীবদ্দশায় পুরো বাংলাকে কবজা করতে পারেননি। এ জন্য মোগলদের অপেক্ষা করতে হয় জাহাঙ্গীরের আমল পর্যন্ত। অথচ চেষ্টা করেছিলেন বাবরও। কিন্তু বাংলার স্বাধীনচেতা জমিদাররা তা হতে দেননি। বাবর তাঁর আত্মজীবনী ‘তুযুক-ই-বাবর’-এ বলেছেন, ‘বাঙালিদের আমি দেখে নেব।’ কিন্তু দেখে নেওয়ার সময় তাঁর নাতিও পাননি। ঈশা খাঁ তো আকবরের সেনাপতি মানসিংহকেও হেস্তনেস্ত করেছেন। বারো ভূঁইয়াদের নেতা আসলে তিনিই। সংখ্যাটা বারো বলে চালু থাকলেও আসলে কিন্তু তেরোর বেশি। এক্ষণে জনাকয় ভূঁইয়ার নাম স্মরণে আনা দরকার—মুসা খাঁ, প্রতাপাদিত্য, চাঁদ রায়, কেদার রায়, কন্দর্প রায়, লক্ষ্মণমাণিক্য, মুকুন্দরাম রায়, ফজল গাজী, বীর হাম্বির, কংসনারায়ণ রায়, রাজা রামকৃষ্ণ, পীতাম্বর, উসমান খাঁ লোহানী, রশ্নি খাঁ প্রমুখ। খেয়াল করার বিষয়, এঁদের কারো নামের শেষেই ভূঁইয়া নেই। তবে তাঁরা প্রত্যেকে বিস্তর ভূমির মালিক ছিলেন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অবশ্য ভূঁইয়ার অস্তিত্ব আছে। মানিকরামের ‘ধর্মমঙ্গল’ এবং মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ পাওয়া যায়, হিন্দু রাজারা সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে তিন শ্রেণির লোক নিয়োগ দিতেন—বড় ভূঁইয়া, মধ্য ভূঁইয়া, ছোট ভূঁইয়া। ধারণা করা হয়, ‘বড় ভূঁইয়া’ শব্দবন্ধটিই লোকের মুখে মুখে ‘বারো ভূঁইয়া’ হয়েছে।
এবার একজন ঐতিহাসিকের দরবারে যাওয়া যাক। তিনি সতীশচন্দ্র মিত্র। লিখেছেন, ‘মোগলদিগের বঙ্গ বিজয়ের প্রাক্কালে বা পরে এইরূপ বারো ভূঁইয়া প্রাধান্য লাভ করেছিল। বলতে গেলে একপ্রকার তাহারাই বঙ্গদেশকে বা নিম্নবঙ্গের দক্ষিণভাগকে নিজেরা ভাগ করিয়া লইয়াছিলেন। এজন্যই বাঙ্গালাকে তখন বারো ভূঁইয়ার মুলুক বা বারো ভাটি বাঙ্গালা বলিত।’
আবার বুড়িচং ভূঁইয়া
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সাবেক এক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া। বলছিলেন, “ ইংরেজ আমল থেকেই আমাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বেশি। আমার দাদা মৃত হাজি এবন আলী ভূঁইয়া অনেক জমির মালিক ছিলেন। দান করার ক্ষেত্রেও এই এলাকায় আমাদের বেশ নামডাক। আমার বাবা মৃত হাজি আবদুল কুদ্দুস ভূঁইয়া আমাদের গ্রামে প্রথম মসজিদের জন্য সম্পূর্ণ একটি জমি দান করেন, মুসল্লিদের অজুর সুবিধার্থে মসজিদের পেছনে বিশাল একটি পুকুর খনন করেন। মসজিদের কাছে প্রায় দেড় বিঘা জমি দেন কবরস্থানের জন্য। আমরা এখানে এসেছিলাম বিক্রমপুর থেকে। ব্যবসা করতেই দাদার বাবার আগমন ঘটেছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ধোপা, চাড়াল (চণ্ডাল), মুচি, শীলসহ (নাপিত) ছয় পেশার লোক। খুব প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এখানে এসে। ইংরেজরা সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘ভূঁইয়া’ খচিত একটি পিতলদণ্ড উপহার দিয়েছিলেন।”