November 12, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

চাম্বল ! বাগি রূপ সিংহ, শেষ বয়সেও এক লাফে উঠে যেতেন উটের পিঠে

[kodex_post_like_buttons]

বন্দুক ওই অঞ্চলের স্টেটাস সিম্বল। পৌরুষের প্রদর্শন। এই উপত্যকায় প্রায় প্রতি উচ্চবর্নের বাড়িতে দু তিনটে করে বন্দুক আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল সারাইয়ের দোকানের মতো বন্দুক সারাইয়ের ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ দেখেছি… সেরকমই কিছু দেখা নিয়ে শুরু  ‘চম্বল কাহিনী’।

সৌগত রায় বর্মন 

আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল একটা স্কুল বাড়িতে। কলকাতা থেকে মেহমান এসেছে সুতরাং এই উৎসব পালনের জন্য স্কুল তো ছুটি করে দিতেই হবে। দুদিন কেটে গেল স্রেফ খাঁটি ও গরম দুধ খেয়ে। সঙ্গে জব, মক্কাই-এর রোটি, আলু ভর্তা, বেগুন ভাজা ইত্যাদি। এত টাটকা আর অর্গানিক সব্জী খেয়ে আমরা তখন দুজনেই ক্রমশ তাগড়া হয়ে উঠছি।

মুসকিলটা অন্য জায়গায়। গ্রামীন জীবনের মায়া আলস্যে আমাদের এক একটা দিন যেন এক একটা মাস বলে মনে হচ্ছে। দিনের প্রতিটি মুহূর্তে, বাচ্চাকাচ্চা মিলিয়ে প্রায় কুড়ি জন আমাদের ঘিরে থাকে। কলকাতা সম্পর্কে তাদের অনন্ত জিজ্ঞাসা। ভাঙা হিন্দিতে তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমাদের প্রতিদিন একটা দুটো করে দাঁত নড়ে যাচ্ছে। মৃদুলদার একটা সুবিধা ছিল, ছবি আঁকা। যখন কথার উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখনই কোনো বাচ্চাকে সামনে বসিয়ে পোট্রেট আঁকতে বসত।  অদ্ভুত ভাবে মিলিয়েও দিত। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত।
আলস্য ভরা এই দুটো দিনে তলে তলে যে কাজ চলছিল তা বুঝতে পারিনি। তৃতীয় দিন সকালে গ্রামের মোহরচাচা এসে খুব উত্তেজিত ভাবে খবর দিল, কাল মুরেনা আদালতে বাগী রূপ সিং আসছে। এক সময় মান সিং এর ডান হাত ছিল। স্পট জাম্পে উটের পিঠে উঠতে পারত। রাতে রতন বলল, কাল খুব সকালে বেরতে হবে। প্রথমে অম্ভ। সেখান থেকে বাস বদল করে মুরেনা শহর। মুরেনায় লোক বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে রূপ সিং কে আটকে রাখবে আদালতে। আমাদের চম্বল অভিযান কি তাহলে সত্যিই শুরু হল?
বাস যাত্রার ফাঁকে বাগী রূপ সিং সম্পর্কে দু চার কথা বলে নেওয়া ভালো।
রূপ সিং ছিল মান সিং এর দলের অন্যতম সদস্য।কনিষ্ঠতম। ৫৫ সালে মান সিং যেদিন পুলিশের গুলিতে মারা গেল, সেই সময় দলের বাকিদের নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মান সিং পূত্র তহসিলদার সিং, সুবেদার সিং এবং এই রূপ সিং পুলিশ বাহিনীকে প্রায় ২৪ ঘন্টা আটকে রেখেছিল। বুলেট ফুরিয়ে গেলে তারা পুলিশের কাছে আত্বসমর্পন করতে বাধ্য হয়। বিচারে ফাঁসির হুকুম হয়। বিনোবা ভাবের সর্বদয়ী মিশন, ডাকাতদের হৃদয় পরবর্তনের আবেদন করে তাদের মুক্ত করে।
পৌঁছে গেল মুরেনা আদালতে। সঙ্গে-সঙ্গেই একজন ছুটতে ছুটতে এসে বলল, আপনারাই কলকাতা থেকে এসেছেন? কি করে চিনল? আমদের চেহারায় হয়তো একটা কলকাত্তাইয়া ছাপ আছে। সে আমাদের নিয়ে গেল একটা জটলার সামনে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিঁসফিঁস করে বলল, মাঝখানে যে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাগী রূপ সিং। দেখলাম লম্বায় ৬ ফুটের উপর একজন লোকের ইয়া মোটা গোঁফ। দাড়ির সঙ্গে মিশে চুলে মিলিয়ে গেছে। বাগীকে ঘিরেই জটলা। সে জিমন্যাস্টিক দেখাচ্ছে । রূপ সিং অবলিলায় এক পা মাটিতে রেখে আরেক পা ওপরে তুলে গাছের মগডাল ছুঁয়ে মাটিতে নামিয়ে আনছে। বয়েস কিন্তু ৬০ পেরিয়েছে । লোকজনের পাস কাটিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল তার কাছে। রূপ সিং ঠাকুর্দার স্নেহে দেহাতি হিন্দিতে আমাদের বলল, এসো, কোথাও একটু বসি। 
আমরা গাছের ছায়ায় বসলাম।
চম্বলের রবিন হুড বাগী মান সিং এর মাত্র ১৭ জনের দলে রূপ সিং যোগ দেয় কিশোর বয়েসে। শুরু হয় তার বাগীর জীবন। বিশেষ কোনো কারণে নয়, প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার মানসিকতাই তাকে নিয়ে এসেছিল ডাকাতের জীবনযাত্রায়। অসংগঠিত লড়াইয়ের ময়দানে।
চোখের সামনে চম্বলের এক ডাকাতকে দেখতে পাচ্ছি  কথা বলছি অথচ একটুও ভয় পাচ্ছি না, এতটাই নরম স্বভাবের মানুয রূপ সিং। কিন্তু এই “খুঁখার” ডাকুকে দেখার একটু আগেও ভয়ে গা শিরশির করছিল। ভয় বা ভক্তি যে কোনো কারণেই হোক তার পায়ের দিকে হাত চলে গেল। কিম্বা চলতি ভাসায় চুক্কিও বলা যেতে পারে। খুব খুশি হল রূপ সিং। আমাদের দুজনের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসালো একটা গাছের তলায়। চম্বলের ইতিহাস, মান সিং এর ইতিহাস এবং আরো কত কথা। মান সিং বনাম পুলিশের ঐতিহাসিক এনকাউন্টারের কথা উঠতেই রূপ সিং এর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে আবার ম্লান হয়ে গেল। একটু দম নিয়ে বলল, ও শালা মুখবির কো বড়েবাবা মার দিয়া। মানে সেই বিশ্বাসঘাতক যে মান সিং এর অবস্থান পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিল, তাকে নবাব সিং গুলিতে ফোঁপড়া করে দিয়েছিল। আবার গর্জন করে উঠল, শালে গদ্দার, ওর মেয়ের বিয়ের সব গয়না ছোটেবাবাই নিজে হাতে করে নিয়ে গিয়ে আশির্বাদ করে এসেছিল। এইটুকু বলে আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর আক্ষেপ করে বলল, আর একটা বুলেটের বেল্ট যদি সঙ্গে থাকত, পুলিশকে আরো একটা দিন আটকে রাখতে পারতাম। বড়েবাবা আরো দূরে পালিয়ে যেতে পারত।
একেই বলে শিভালরি!  মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কাহানি শোনার পর আমরা ভয়ে ভয়ে বললাম, শুনেছি আপনি নাকি এক লাফে উটের পিঠে উঠতে পারতেন? হো: হো: করে হেসে উঠল রূপ সিং। আমি তো বুড্ঢা হয়ে গেছি। এখন কি আর পারবো? আমরাও তার পা ধরে বসে রইলাম। যে ভাবেই হোক, পারাতেই হবে। কিন্তু একটা ভয় যে আমাদের মধ্যে কাজ করছিল না, তা নয়। এক লাফে উটের পিঠে উঠতে গিয়ে বাগীজীর যদি ঠ্যাং ভেঙে যায়, তাহলে কি আমরাও গুলিতে ফোঁপড়া হয়ে যাবো?  গেলে যাবো। এটুকু রিস্ক তো আমাদের নিতেই হবে। ভয়ে ভয়ে দেখলাম, রূপ সিং কাধের বন্দুক নামিয়ে রাখল। ধুতি গুটিয়ে ল্যাংগোট বানিয়ে ফেলল। তারপর বার দশেক ডন মেরে রক্ত গরম করে নিল। গাছের তলাতেই রূপ সিং এর নিজস্ব উট বাঁধা ছিল। মাথার পাগড়ি খুলে রূপ সিং গিয়ে দাঁড়াল একটু দূরে।
চারদিক স্তব্ধ। পাখিও যেন  ডাকতে ভুলে গেছে। পরিবেশ থমথমে।
রূপ সিং বেশ কয়েকটা বড় বড় নিশ্বাস নিল। মাথা নিচু করে কাউকে যেন প্রনাম করে নিল। শুরু হল দৌড় । কতদুর? বড় জোর ২০ ফুট। একটা ছিপছিপে ফর্সা,  অর্ধনগ্ন শরীর হপ স্টেপ জাম্পের স্টাইলে ছুটে এসে শূন্যে উঠে গেল। আমাদের অনেকেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। আমিও।
প্রবল উল্লাসের শব্দে চোখ খুললাম। দেখলাম উটের পিঠে বসে আছেন বাগী রূপ সিং।
এই ছবি তৎকালীন “পরিবর্তন” পত্রিকার কভার ছবি হয়েছিল। আমার কাছে সেই স্মৃতি নেই, হারিয়ে ফেলেছি। মৃদুলদার কাছে আছে কিনা জানি না। ক্ষতি নেই। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে নিশ্চয় আছে।
ভোরে রছেড় থেকে বেরতেই মনে হয়েছিল, দু দিন বিশ্রামের পর আজ ঘটনার ঘনঘটা ঘটবে। ঝুলিতে একজন মাত্র বাগী ঢুকেছে, কিন্তু বাকীরা? আসবে তো? রতন যখন কথা দিয়েছে তখন আমাদের আটকায় কে? আমাদের সেই শুভানুধ্যায়ী কার সঙ্গে যেন কথা বলে বেশ উত্তেজিত ভাবে আমাদের জানাল, দাজু আজ কোঠি মে আয়া। তুম লোগ জায়েগা? কিন্তু দাজু কে? আমরা কোথায় যাবো?  লোকটা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, দাজু,,, দাজু,,, মানে মান সিং এর বেটা তহসিলদার সিং।
তাকে কি মিস করা যায়? আমরা লাফিয়ে উঠলাম। যে ভাবেই হোক যাবো। যেতে হবে আগ্রা। তাও মূল শহর থেকে একটু দূরে। কে আনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে? আমাদের মনের অবস্থা বুঝে সে বলল, কেন? আমি যাবো। রাতে তোমরা দাজুর বাড়িতেই থাকবে। দাজু কাউকে ফেরায় না।
আগ্রা শহরে পৌঁছতে সন্ধে ৭ টা বেজে গেল। আমাদের গাইড রাস্তা দেখিয়ে দাজুর বাড়িতে নিয়ে গেল। দোতলা কোঠি। শুভানুধ্যায়ী বলল, আপনারা দাঁড়ান। আমি দেখে আসি তিনি আছেন কি না? কিংবদন্তি বাগী যে শূন্যে পয়সা ছুড়ে বুলেট ছুড়ে নামিয়ে আনতে পারতেন। ২৪ ঘন্টা পুলিশ বাহিনীকে আটকে রেখেছিলেন। এই যার বায়োডাটা, সে আমাদের সঙ্গে দেখা করবে কেন? ৮৭ টা খুনের মামলা যার বিরুদ্ধে আছে তাকে দেখতে পারবো? সঙ্গে-সঙ্গে এটাও ভাবলাম ভয়ের কি আছে? বায়োডাটায় আরো দুটো খুন হয়তো যোগ হবে। তাই হোক।
শুভানুধ্যায়ী এসে জানাল, উপরে যেতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি না হাওয়ায় ভাসছি, বুঝতে পারছি না।
কিন্তু দরজায় এ কে দাঁড়িয়ে আছে? চেহারায় স্যার আশুতোষ নাকি? গোঁফ পাকানো নয়, ঝোলা। পরনে খাদির পাঞ্জাবি, জহরকোট, ধুতি  আর মোটা চাদর। আমরা দু’জনেই ততক্ষণে দাজুর পায়ে পড়ে গেছি, যাতে বুলেট না খেতে হয়। দাজু আমাদের বুকে টেনে নিলেন। হৃদয়ের উষ্ণতা টের পেলাম। দাজু একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুয। গত জীবনের কথা প্রায় বলতেই চান না। বলার যেন কোনো উৎসাহই নেই। উদাসীন।  চোখ দুটি স্থির, শান্ত। উনি এখন বিনবা ভাবের শিষ্যত্ব নিয়েছেন। বাগীদের পরামর্শ দেন ডাকুগিরি ছেড়ে চাষবাসে ফিরে আসতে। 
আমরা প্রশ্ন করলাম, সঙ্গে বন্দুক রখেন না। যদি কেউ প্রতিহিংসা নেয়, তাতেও দু:খ নেই। পাপ স্খলন হবে।
দাজু তহসিলদার সিং এক সময় নির্দল প্রাথী হয়ে পরাজিত হন মুলায়েম সিং এর কাছে।
-ক্রমশ 

Related Posts

Leave a Reply