চম্বল! যেখানে আজও জ্বলছে প্রতিহিংসার আগুন (তৃতীয় পর্ব)
[kodex_post_like_buttons]

বন্দুক ওই অঞ্চলের স্টেটাস সিম্বল। পৌরুষের প্রদর্শন। এই উপত্যকায় প্রায় প্রতি উচ্চবর্নের বাড়িতে দু তিনটে করে বন্দুক আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল সারাইয়ের দোকানের মতো বন্দুক সারাইয়ের ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ দেখেছি… সেরকমই কিছু দেখা নিয়ে শুরু ‘চম্বল কাহিনী’।
সৌগত রায় বর্মন
১
“তুফান মেল’ আগ্রায় ঢোকার আগেই সহযাত্রীরা হই হই করে জানালার দিকে ধেয়ে গেল। আমরাও। ওমা, চোখের সামনেই তাজমহল। জীবনে প্রথম ওই সৌধ দেখার পর প্রবল উত্তেজনা বোধ করেছিলাম। মৃদুলদা বলল, আগে হোটেলে চল, খাওয়া দাওয়া শেয করে দেখতে যাবো।
হোটেলটার নাম এখনও মনে আছে। “ক্যালকাটা হোটেল “। হোটেল না বলে সরাইখানা বলাই ভালো। ঠান্ডা জলে স্নান করে দীর্ঘ রেলযাত্রার ক্লান্তি কাটিয়ে খেতে বসা হল। খাওয়া মানে মহাভোজ। আতপ চালের ভাত, মুগের ডাল,আলুভাজা আর বেগুন ভর্তা। মুসকিলটা হল, আমার লিডার মৃদুল দা চড়ুই পাখির চাইতেও কম খায়। আমি খাদ্য রসিক। কিন্তু চড়ুইয়ের সামনে হাতির মত খাওয়া মোটেই শোভন নয়। তাই পুরো চম্বল অভিযন পর্বটাই আমাকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়েছিল।
বিকেলে তাজমহল দেখে মোটেই খুব একটা উত্তেজিত হলাম না।আসলে উপভোগ করার মতো মনের অবস্থাও আমাদের ছিলো না। এই অভিযানে আমাদের সম্বল শুধু একটা ছেড়া কাগজের চিরকুট। যতক্ষণ না তা রছেড় গ্রামের রতন সিংয়ের হাতে পৌঁছতে পারি ততক্ষন আমরা দু:স্বপ্নের মধ্যে রাত কাটাতাম। ধীরেনদাকে বড় মুখ করে বলে এসেছি, না পারলে “পরিবর্তন” এর চাকরিটাই ছেড়ে দিতে হবে। লজ্জায়।
বিকেলে হোটেলে ফিরেই ঠিক করলাম আজ রাতের ট্রেনেই মুরেনা চলে যাবো। সন্ধে ৭টায় ট্রেন। রাত ১০টার মধ্যে মুরেনা পৌঁছে যাবে।
এখানে ভারতীয় রেলের একটা মজার ব্যাপার আছে। আগ্রা থেকে মুরেনা ঠিক ৩টে স্টেশন। আগ্রা, ঢোলপুর, মুরেনা। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার। তিনটে স্টেশন তিনটি রাজ্যে। আগ্রা উত্তরপ্রদেশে, ঢোলপুর রাজস্থানে আর মুরেনা মধ্যপ্রদেশে। দেশের আর কোথাও এই মজা নেই।
সহযাত্রীরা সবাই যাচ্ছে মুরেনার পরের স্টেশন গোয়ালিয়র। আমরা তাদের বারবার ‘ মুরেনা কব আয়েগা, কব আয়েগা জিজ্ঞেশ করতেই তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেশ করল, আপলগ কহা উতরেংগে ? মুরেনায় নামবো শুনে তারা হতবাক! আমাদের মস্তিস্কের সুস্থতা সম্পর্কে তারা সন্দিহান হয়ে উঠল। কেউ কেউ বলেও ফেলল, ইতনা রাতমে মুরেনামে কেয়া কাম হ্যায়? ওটা তো চম্বল ঘাটি। সবলোক ডাকু হ্যায়।কেয়া করনা উধার? আমরা দুজনেই তখন বছর কুরির কোঠায়! সেটাও তাদের কাছে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। তার উপর বংগাল সে আয়া!। খুবই সন্দেহের কারণ। বাধ্য হয়ে আমরা নিজেদের পত্রকার পরিচয় দিলাম। ডাকুদের নিয়ে কাহানি লিখব শুনে কতটা বিশ্বাস করল, বোঝা গেল না। তবে তারা সবাই মিলে অনুরোধ করল, আমরা যেন গোয়ালিওয় চলে যাই। রাত্র ওখানে থেকে, সকাল বেলায় মুরেনা আসি। আমরা কিন্তু নাছোড়বান্দা। মুরেনাতেই নামবো।
অবশেযে নামলাম মুরেনায়।রাত দশটা বেজে গেছে। গাঢ় কুয়াযায় টিম টিম করে জ্বলছে গ্যাসের বাতি। পুরো ট্রেন থেকে নামলাম আমরা ২ জন। তখন স্লিপিং ব্যাগ আর রুকস্যাকের রমরমা শুরু হয়নি। আমাদের সঙ্গে সেই চিরকালীন বেডিং আর সুটকেস। মালপত্র নামিয়ে দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালাম। কুয়াশার চাদরের দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে গেল। নবগ্রাম থেকে হরিদেবপুর হয়ে চম্বল এসেছি। সামনে অনেক কাজ। হবে তো?
২
মৃদুলদা আর আমি দুজনেই নির্বাক। এক অখন্ড নীরবতা যেন গ্রাস করছে আমাদের। কেউ কোথাও নেই। এখন উপায়? হঠাতই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা দীর্ঘ লম্বা শরীর আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। গায়ে কুলির পোশাক। আমাদের দিকে তাকিয়ে স্নেহ মাখা গলায় জিজ্ঞেশ করল, কাঁহা জানা বাবুজী? আমরা খড়কুটো আশ্রয় করার মত করে জিজ্ঞেশ করলাম, ভাইয়া, ইধার ঠহরনে কা কোই জায়গা হ্যায়? কাল সুবা চলে যাব। লোকটা আর কোনো কথা না বলে আমাদের মালপত্র মাথায় তুলে হাঁটতে লাগল। আমরা পিছু পিছু। লোকটা ডাকু নয় তো? জানি না। যাইহোক এ গলি সে গলি ঘুরতে ঘুরতে একটা হাভেলির সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় ধাক্কা মেরে বলল, কেদার! কেদার! মেহমান আয়া। খুট করে দরজা খুলে একটা কিশোর ছেলে আমাদের সামনে এসে বলল, কোই ঘর খালি নেহি হ্যায়! বারান্দায় খাটিয়া পেতে দিতে পারি। আমরা রাজী। কনকনে শীতে বারন্দায় কম্বলে মুখ ঢেকে শোয়া একটা অভিজ্ঞতা নিশ্চয়। কিন্তু খাবার? পেট যে কুই কুই করছে। কেদার নিরুপায়। খানা নেহি মিলেগা? এমন সময় এক দীর্ঘাংগী চম্বল রমনী, বয়েস ৭০ এর কাছাকাছি, কেদারকে এক ধমক দিয়ে বলল, আটা নিয়ে আয়। সঙ্গে দুধ। উনুনে আঁচ দিয়ে রমনী আমাদের দুজনকে চারটে চারটে রুটি আর দুধ দিয়ে বলল, খা লো বেটা। সব্জী খতম হো গেয়া।
খাওয়া দাওয়া সেরে আম্মাকে নিয়ে বসলাম। সব কিছু খুলেবলাই মনস্থ করলাম। পত্রকার পরিচয়ও দিলাম। আম্মার মুখ দেখে মনে হল, খুব খুশী হলেন। বঙ্গাল থেকে এসেছি শুনে আরো যেন বেশী । বললাম, রছেড় গ্রামে আমাদের এক জানপহেচান আদমি আছে। তার কাছে যাবো। কি করে তার কাছে পৌঁছতে হবে সেই রাস্তা আম্মাই বলে দিল, কাল সকাল ৬টায় একটা বাস ছাড়বে। সেটা যাবে অম্ভ। সেখান থেকে রছেড়ের বাস পাওয়া যাবে। কেদার মালপত্র বাসে তুলে দিয়ে আমাদের সিটে বসিয়েও দেবে। কৃতজ্ঞতায় আমরা তখন নতজানু। আম্মার কথা অনুযায়ী সে রাতে ঘুমিয়ে পড়তে হল। সকাল সকাল উঠতে হবে যে।
৪
ডিসেম্বর মাস। মধ্যপ্রদেশ। সকাল ৬টা। অকল্পনীয় ঠান্ডা। কাঁপতে কাঁপতে বাসের নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসলাম। একেবারে ভি আই পি ব্যবস্থা। বাসের সবাই ততক্ষনে জেনে গেছে আমরা চম্বলের গেস্ট। আমাদের আশেপাশে গোটা দশেক বন্দুকধারী মানুয নিশ্চিন্তে বসে আছে। লালমোহনবাবুর মতো মৃদুলদাকে ফিঁসফিঁস করে প্রশ্ন করে বসলাম, ডাকু হ্যায় কেয়া? মৃদুলদা আংগুল দিয়ে বাসের গেটের ওপরের একটা সরকারী সাবধানবাণী দেখিয়ে বলল, পড়ে দেখ। দেখলাম লেখা আছে ‘ভরি বন্দুক লে কর ন বইঠো ‘। মানে গুলি ভরা বন্দুক নিয়ে বাসে বসিবেন না।
রাস্তা যেন অনন্ত। দুপাশে ছোট ছোট ঝোপঝাড়। এখানকার একটা মজা হল, বাস রাস্তা থেকে কোনো গ্রামের চিহ্নই দেখা যায় না। মাঝে মাঝেই খোয়াই বা বেহড়। পাশের যাত্রীকে জিজ্ঞেশ করাতে সে উত্তর দিল, ইয়ে ভগবান কা দান। যা সমতল থেকে কখনো ৫০০ মিটার, কখনো বা ১০০০ মিটার নিচে নেমে গেছে। দিনের আলো এখানে মাঝে মধ্যে মুখ দেখায়। তার কথা অনুযায়ী এখানকার ডাকুরা কেউ ডাকাইত নয়। বাগী। মাননীয় ডাকাতদের ডাকু বলা এখানে নিষিদ্ধ। ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করবে বলেই তারা গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করে বেহড়ে ঢুকে পড়েছে।
এই অনন্ত বেহড় আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখল ঘন্টার পর ঘন্টা। মনে কিন্তু আমাদের এতটুকু শান্তি নেই। রছেড় পৌঁছে রতন সিং এর দেখা পাবো তো? তাড়িয়ে দেবে না তো!
এইভাবেই এক বুক আশংকা নিয়ে পৌঁছে গেলাম অম্ভ। বেশ বড় বাস জংশন। এখান থেকেই এটাওয়াগামী বাস ধরতে হবে। মাঝখানে রছেড় গ্রাম পড়বে। আমাদের গন্তব্য যত কাছে আসছে ততই বুকের ধড়পড়ানি বেড়ে যাচ্ছে। শীতের বেলা। সূর্য ক্রমশ দিকবলয়ে নেমে যাচ্ছে। হালকা কুয়াশার চাদর যেন ঢেকে দিচ্ছে চারদিক।
এক সময় প্রত্যাশিত রছেড় এসে গেল। কন্ডাক্টর চিন্তিত মুখে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলল, এটাই রছেড় গ্রাম। কেউ যদি না নিতে আসে তবে আমরা ফেরার সময়ে তুলে নিয়ে তোমাদের অম্ভ পৌঁছে দেব।
কুয়াযার মধ্যে কালো পিচের রাস্তা। দূরে বাসের ব্যাক লাইট মিলিয়ে যাবার পর মনে হতে লাগল এই পৃথিবীতে আমি আর মৃদুলদা ছাড়া আর কেউ থাকেনা। আমরা দুজনেই তখন মৌনব্রত পালন করে চলেছি। দুজনেই মাংকি ক্যাপ পড়ে লামা সেজে বসে আছি। আমি একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। বললাম। মৃদুলদা, ডাকুরা কি হাড় বেছে মাংস খায়? উত্তর দেওয়ার বদলে মৃদুলদা হঠাত চেঁচিয়ে উঠল, ওই দেখ! ঘন হয়ে আসা কুয়াযার মধ্যে দেখলাম দুটো আলো। দুলছে। মৃদ্যলদা আমার কাঁধ খামছে বলে উঠল, নিশ্চয় হ্যারিকেন। নইলে দুলত না। সঙ্গে বেশ কয়েকটা টর্চের আলো। শেয প্রহরের ম্লান আলোয় দেখা গেল একটা গরুর গাড়ি এগিয়ে আসছে। তাকে ঘিরে এক দঙ্গল ছেলে পিলে। তারা এত বাচ্চা যে নিশ্চয় ডাকাত হতে পারে না । মৃদুলদাকে জড়িয়ে ধরলাম। মৃদুলদাও আমাকে।
গুরুর গাড়ি কাছে এল । লাফিয়ে নামল আমাদেরই বয়েসি একটি একমাথা চুল যুবক। আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে পরিস্কার বাংলায় বলে উঠল, আমিই রতন সিং। পিতাজির সঙ্গে অনেকদিন কলকাতায় ছিলাম। বাবা চিঠিতে সব লিখে দিয়েছে। গাড়িতে উঠুন। এই অন্ধকারে গাঁয়ে যেতে সময় লাগবে। আপনারা এখন থেকে আমাদের অতিথি। খানা খান। ঘুমান। বেহড়ে বেড়াতে যান। দেখুন আপনাদের অভিশপ্ত চম্বল আসলে কত সুন্দর। আমরা হায় হায় করে উঠলাম। চিন্তিত মুখে জবাব দিলাম, কিন্তু আমাদের কাজ?
রতন রহস্যের হাসি হেসে বলল, মান লিজিয়ে কি আপকা কাম হো গেয়া।
ক্রমশ …