November 22, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

চম্বল! যেখানে বুলেটের শব্দে ময়ূর নাচে (দ্বিতীয় পর্ব)

[kodex_post_like_buttons]

বন্দুক ওই অঞ্চলের স্টেটাস সিম্বল। পৌরুষের প্রদর্শন। এই উপত্যকায় প্রায় প্রতি উচ্চবর্নের বাড়িতে দু তিনটে করে বন্দুক আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল সারাইয়ের দোকানের মতো বন্দুক সারাইয়ের ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ দেখেছি… সেরকমই কিছু দেখা নিয়ে শুরু  ‘চম্বল কাহিনী’।

সৌগত রায় বর্মন 

 

রেল যাত্রার দীর্ঘ অবসরে বরঞ্চ চম্বল প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে নিলে মন্দ হয় না। অভিশপ্ত চম্বল নামে কিন্তু কোনো জায়গা নেই। যা আছে তা একটি শান্ত ও মিস্টি নদী। নাম চম্বল। উতপত্তি বিন্ধাচল পর্বত, সমাপ্তি যমুনা নদীতে । এই নদী লম্বায় প্রায় ৯৬০ কিমি। মূলত তিনটি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে এর যাতায়াত। মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থান। চম্বল নদী দেশের সব চাইতে কম দুযিত ও একই সঙ্গে উর্ধগামী। প্রাচিন নাম ছিল চমনবতী। এই রকম একটি শান্ত নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির মানুযের রক্তে কেন ডাকাতির নেশা চেপে গেল, সেটা একটা প্রশ্ন। এক কথায় এর উত্তর পাওয়া যাবে না।
প্রথম কারণ অবশ্যই ভূপ্রকৃতি। চম্বল বলতে বোঝায় প্রায় ১০ হাজার কিমি একটা বিস্তৃণ উপত্যকা ভূমি। কিন্তু রহস্যময়ী। নদীর দু পাশে আছে বিস্তৃত “বেহড়”। এই বেহড় এমনই একটি গোলকধাঁধা যার রহস্য আজও অনাবিস্কৃত। 
অতীতে চম্বল নদী বহুবার তার দিক পরিবর্তন করেছে। একই রকমভাবে যমুনা নদীও। ফলে দুটো নদীই আনাদী কাল থেকে ভেঙে দিয়েছে দুই পাড়। তাদের এই খেয়লখুশীর ফল বেহড়। ভঙ্গুর মাটি মাইলের পর মাইল রচনা করেছে একদা নদী গর্জের অন্ধিসন্ধির গলিঘুপছির বেহড়। চম্বল উপত্যকার মাটি অনুর্বর, ক্ষয়িষ্ণ। ফলে বেহড় বা ইংরেজিতে যাকে র‍্যাভাইন্স বলে তা আজ ও তার রহস্য ধরে রেখেছে।
বেহড় কিন্তু কোনো পাহাড় নয়। বরঞ্চ মাটির গর্ভে সুকনো রহস্য, সমতল থেকে কখনো ৫০০ কখনো ১০০০ বা ২০০০ ফুট,  নীচু মাটির গলিপথ। এ পথে ঘোড়া ছোটে না। মাঝে মাঝে ছাগল ঢুকে পড়ে। বেহড়রহস্য তিনটি রাজ্য যেমন মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের মধ্যে এক গোপন অপরাধ সরণী বজায় রেখেছে। ডাকাতরা এই বেহড়ের মধ্যে দিয়ে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পউছে যেতে পারে নিমেষের মধ্যে, যা পুলিশের পক্ষে সম্ভবপর  নয় কোনো মতেই। চম্বলের বাসিন্দারা এই বেহড় গলিপথ চেনে হাতের তালুর মতই। অন্য প্রদেশের পুলিশের পক্ষে হয়তো বুঝতে সময় লাগতে পারে কয়েক যুগ। এখনো এই বেহড়ের কোনো মাণচিত্র তৈরী করা যায়নি। স্যাটেলাইট ক্যামেরার চোখ আর যাই হোক মাটির তলায় যাবে না।। অপরাধ করে বেহড়ে ঢুকে গেলে পুলিশ তো কোন ছার, সেনাদলের পক্ষেও তাকে খুঁজে বার করার উপায় নেই।
এতো গেল ভূপ্রাকৃতিক কারণ। দ্বিতীয় কারণটা মানসিক। এই অঞ্চলের মানুষদের তীব্র জাত্মাভিমান। সামান্য অপমানও তারা মেনে নিতে নারাজ। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে একচেটিয়া ঠাকুরদের আধিপত্ব । ক্ষত্রীয় বংশজাত বলে তাদের রোয়াব এত বেশী। শিভালরি তাদের রক্তে। ডাকু মান সিং, নবাব সিং, মোহর সিং, সবাই এই সম্প্রদায়ের। তরুণ ভাদুরীর “অভিশপ্ত চম্বল” লেখার পর চম্বল নামটি আমাদের গোচরে আসে। ৭ এর দশকে এই উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছিল।
চম্বলের ডাকাতি সংক্রান্ত সমস্যা কিন্তু অতি প্রাচিন। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে ১৮৩০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার রাজত্ব কালে চম্বল উপত্যকায় ” এয়ন্টি ডেকয়িটি অ্যাক্ট” চালু হয়েছিল। ১৮৩৬ সাল নাগাদ এই আইন লাগু করা হয় চম্বল উপত্যকার জন্য।
 এই সময়েই ডাকাত ঠেকাতে উচ্চ বর্ণের মানুযদের জন্য ঢালাও বন্দুক বিলির ব্যবস্থা করা হয়। আগ্রা শহরের বাইরে বেরলেই দেখা যাবে কাঁধে রাইফেল, মাথায় সাদা পাগড়ি, গায়ে ফুল হাতা ফতুয়া আর জহর কোট পড়ে মানুয ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। বন্দুক ওই অঞ্চলের স্টেটাস সিম্বল। পৌরুষের প্রদর্শন। এই উপত্যকায় প্রায় প্রতি উচ্চবর্নের বাড়িতে দু তিনটে করে বন্দুক আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল 
সারাইয়ের দোকানের মতো বন্দুক সারাইয়ের ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ দেখেছি।
তবে মুসকিল এই সব বন্দুক কখনো ডাকাত দমনে ব্যবহার হয়নি। উলটে ডাকাতদের হাতেই গেছে। অথবা মানুযকে সামান্য কারণে ডাকাত বানিয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে এই অঞ্চলের মানুযের প্রবল জাত্মাভিমান। কিংবদন্তি ডাকু মান সিং কিন্তু উচ্চ বর্নের মানুয। ঠাকুর সম্প্রদায়ের। তিনি ডাকাত হয়েছিলেন কোনো আর্থ সামাজিক কারণে নয়। স্রেফ অপমানের জবাব দেবার কারণে।
মান সিং এর পাশের গ্রামে থাকতেন এক ব্রাহ্মন পরিবার। তল্ফিরাম। তাদের সঙ্গে মোটেই বনিবনা ছিল না ঠাকুর পরিবারের।  ব্রাহ্মন বনাম ক্ষত্রীয়র চিরকালীন দ্বন্দ। একদিন ঘরে পানীয় জলের অভাব মেটাতে মান সিং পরিবারের মেয়ে বউরা কলসি মাথায় গেল পাশের গ্রামের ইঁদারা থেকে জল আনতে। তল্ফিরামের ইঁদারা। ব্রাহ্মন পরিবারের জল স্পর্শ করার সাহস দেখানো জাতপাতের নিরিখে যথেষ্ট অপরাধের। সিং পরিবারের মেয়েরা লাঞ্ছিত হল ব্রাহ্মন পরিবারের হাতে। সেই খবর পৌঁছে গেল খেরা রাঠোর গ্রামে মান সিংয়ের বাড়িতে। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠল মান সিং, দাদা নবাব সিং, ছেলে সুবেদার সিং আর তহসিলদার সিং। হাতে বন্দুক, গলায় বুলেটের মালা পড়ে ছুটে বেড়িয়ে গেল ওরা চার জন। কিচুক্ষনের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ব্রাহ্মম পরিবারের ইজ্জত লুঠনেওয়ালারা। ব্রাশ ফায়ার।  রক্তে লাল হল খেরা রাঠোর গ্রাম। তৈরী হল চম্বলের প্রথম রবিন হুড, মান সিং বাগী।
১৯৩৯ সালে মান সিং ডাকু হন। ১৯৫৫ সালে মারা যান পুলিশের গুলিতে। মান সিং এর বিরুদ্ধে এই ১৬ বছরে ১ হাজার ১১২টি ডাকাতির অভিয়োগ ছিল। হত্যার অভিয়োগ ১৮৬টি। তার মধ্যে পুলিশ অফিসার ৩২ জন।
সেই খুঁখার ডাকু মানি সিংয়ের কোঠিতে আমি আর মৃদুল দা বাস করেছিলাম দু দিন দু রাত।
মান সিং মারা গেছেন ১৯৫৫ সালে, তবে জীবিত ছিলেন শতবর্শ পেরোনো বড়েবাবা নবাব সিং। মান সিং এর বড় ভাই। তার বিরুদ্ধে ১০৭ টি খুনের অভিযোগ ছিল। আজ ৪০ বছর বাদে ভাবতে বসলে গর্বই হয়। যে বাড়িতে কোনো দিনও পুলিশ ঢুকতে পারেনি সেখানে মেহমান হয়ে ছিলাম আমরা। শুধু তাই নয়, উটের পিঠে বেহড়ের পর বেহড় ঘুরেছি, শুনেছি ডাকাতির “গৌরবের’ কাহানি! তারিখটা সম্ভবত ছিল ১৯ নভেম্বর, সাল ১৯৭৯। 

Related Posts

Leave a Reply