November 12, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

চম্বল! যেখানে বুলেটের শব্দে ময়ূর নাচে (প্রথম পর্ব)

[kodex_post_like_buttons]

বন্দুক ওই অঞ্চলের স্টেটাস সিম্বল। পৌরুষের প্রদর্শন। এই উপত্যকায় প্রায় প্রতি উচ্চবর্নের বাড়িতে দু তিনটে করে বন্দুক আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সাইকেল সারাইয়ের দোকানের মতো বন্দুক সারাইয়ের ছোটো ছোটো ওয়ার্কশপ দেখেছি… সেরকমই কিছু দেখা নিয়ে শুরু  ‘চম্বল কাহিনী’ আজ প্রথম পর্ব।  

সৌগত রায় বর্মন 
ক্যারিসম্যাটিক  ক্যারেক্টার । আমাদের বিজুদা। শ্রীযুক্ত কিশোর দা নামেই তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। চিরকিশোর বিজুদাই আমার জীবনটাকে অন্য খাতে বইয়ে দিয়েছিল। বিজুদা আমার মাসতুতো দাদা, অকৃতদার।বাউন্ডুলে।
আমার যৌবনের আখরা ছিল হরিদেবপুর। আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি। বিজুদা ও দাদাভাইয়ের বাউন্ডুলে সংসারে এক সময় আমার পিসতুতো দিদি ঝুমুদি এসে এই সংসারে লক্ষীর পদচিহ্ন এঁকে দেয়।
যে সময়কার কথা হচ্ছে তা ৭৯ সাল। স্বেচ্ছায় নিজের পেশা ঠিক করে ফেলেছি। চিত্র সাংবাদিকতা। ঝাড়খন্ড কভার করে পত্র পত্রিকা মহলে সামান্য পরিচিতি হয়েছে।  রক্তে adventurer নেশা লেগে গেছে।  ঠিক এরকম্ই অসস্থিরতার সূত্র খুঁজতে খঁজতে একটা আইডিয়া মাথায় এসে গেল।
সে সময় বিজুদা ওষুধ এর ব্যবসা ছেড়ে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা শুরু করেছেন। দাদার পার্টনার আজিত সিং মাঝে মাঝেই হরিদেবপুরের বাড়িতে আসতেন। ঠোঁট থেকে কান পর্যন্ত ইয়া পাকানো গোঁফ। তাগড়াই চেহারা। প্রায় সাড়ে ৬ ফুট লম্বা। পরনে পাট করে পরা ধুতি আর ফতুয়া।বিজুদার সঙ্গে কাজের কথা শেয করে আড্ডা মারতে বসতেন।
তার আড্ডা একটাই, কি ভাবে তিনি ডাকু মান সিংহের কোলে পিঠে মানুয হয়েছিলেন, সেই কাহিনি। চম্বল তার রক্তে, গর্বে। এই গল্প শুনে আমি চোরা দৃষ্টিতে বিজুদার দিকে তাকাতাম, বিজুদা তখনই বলে উঠতেন, সিংজি চম্বলের লোক। মানসিং এর রিস্তেদার। এই সার্টিফিকেট পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে তার গল্পের উট ছোটাতেন সিংজী।
তখন আমার রক্তে সাংবাদিকতার নেশা ঢুকে গেছে। একদিন রাতে বিজুদার জন্য এক প্যাকেট চারমিনার কিনে হরিদেবপুরে হাজির হলাম। ইতিমধ্যেই বিজুদার ২ হাজার সিগারেট হজম করে, মাত্র ১০টা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করে মধূ ঢালা গলায় বললাম, বিজুদা, সিংজী যে চম্বলের গপ্পগুলি শোনায় তা কি সত্যি? বিজুদা একটু রেগেই গেলেন, সবাইকে অবিশ্বাস করা তোদের একটা মস্ত দোষ। ওরকম গোঁফওলা মানুয কখনো মিথ্যে বলতে পারে? মনে মনে বললাম, না  পারে না। মানুষকে গোঁফ দিয়ে যায় চেনা। আত্ববিশ্বাস ফিরে পেয়ে বিজুদার ঠোঁটে একটা সিগারেট গুঁজে দিয়ে, তাতে আগুন ধরিয়ে কান্না মেশানো গলায় বললাম, একটা ব্যবস্থা করে দাও না দাদা,  চম্বল যাই। বিজুদা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, তা হবে না, মাসিমার পার্মিশন না পেলে তোর যাওয়া নামুমকিন।তখন টেলিফোনই ছিলো না তো মোবাইল ফোন! নবগ্রামে ফিরে গিয়ে মা’র হ্যাঁবাচক চিঠি নিয়ে আসা তো বেশ কয়েক দিনের ঝামেলা। 
সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। চম্বল মানে ডাকু মান সিং নবাব সিং, রূপা, পুতলী বাঈ, বন্দুকের লড়াই? মনে মনে মা’র কাছে আবদার করলাম, মাগো, তুমি তো জানোই, তোমার এই শেষ বয়সের পোলাটা একটা উড়নচন্ডী। মা তুমি রাণি রাসমণি, কাউকে ফেরাও না। আমাকে ফিরিয়ে দিও না মা।তাহলে সন্ন্যাস নেব।
আধোঘুমে আধো জাগরনে সকাল হল। যে বিজুদার দু গ্লাস লাল চা আর চারটে চারমিনার না খেলে ঘুম ভাঙে না সেই তিনি আমার জন্য চা নিজের হাতে বানিয়ে মশারি তুলে আমাকে ঘুম থেকে তুললেন। চল, চল, সিংজীর বাড়ি যাবি না? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আমি তো হতবাক। 
চেতলায়  দূর্গাপুর ব্রিজের তলায় সিংজির বাড়ি। পৌঁছে গেলাম সক্কাল সক্কাল। ঘরে ছিপছিপে তন্বী বউ। সন্দেহ হচ্ছিল মেয়ে না বউ। সিংজীই পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেরা ওয়াইফ লক্ষ্মী। এক মাথা ঘোমটা টেনে লক্ষ্মী বউদি গরম গরম পরোটা আর রাজমার সবজি নিয়ে এলো। এ বাড়িতে চায়ের কোনো পাট নেই। এলো ঘোলের মাঠা। 
বিজুদাই কথাটা তুললেন, সিংজী, আমার ভাই তো তোমার দেশে যেতে চাইছে। ও তো পত্রকার। তোমরা যাদের ডাকু না বাগী কি বল, তাদের সঙ্গে কথা বলবে, ছবি তুলবে। ব্যবস্থা করা যাবে? সিংজীর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, কিউ ব্যবস্থা নেহি হোগা? ওখানে আমার দুসরা বিবি আছে। লড়কা আছে। রতন। ওকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। ওর হাতে শুধু পৌঁছে দিতে হবে। তারপর থেকে তুমি হবে চম্বল কি মেহেমান। বেহড় দেখবে, জব-মক্কাইয়ের রোটি খাবে। জার্সি গোরুর দুধ খাবে। কলকাতা ফিরে দেখবে কিতনা মোটা হো গয়া । আমি হায় হায় করে উঠলাম, সিংজী আমি মোটেই মোটা হতে যাচ্ছি না। কাজে যাচ্ছি। মান সিং, নবাব সিং এর বাড়ি যাবো না? সিংজী ফুতকারে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, সে আর এমন কী কঠিন কাজ? মানসিং এর গ্রাম আমার গ্রাম থেকে উটের পিঠেই যাওয়া যায়। তোমার সব কাজ হয়ে যাবে। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। এবার যাওয়ার তইয়ারি কর।
সিংজীর চিঠি কিন্তু বিজুদা ছো: মেরে কেড়ে নিয়ে আমার দিকে ফিচেল হাসি হেসে বললেন, আগে মাসিমার চিঠি তারপর চম্বলের ভিসা।
পরিবর্তন পত্রিকায় তখন সম্পাদক ছিলেন ধীরেন দেবনাথ। প্রধান সম্পাদক অশোক চৌধুরী । আজকের অনেক দিকপাল সাংবাদিকের জন্ম দিয়েছিল এই পত্রিকা। তাদেরই একজন ছিলেন আমার সহকর্মী মৃদুল দাশগুপ্ত। চম্বল যাওয়ার ভিসা যে প্রায় আমার হাতে এসে গেছে তা ধীরেনদাকে সরাসরি বলার অর্থ পরীক্ষায় শূন্য পাওয়া। মাত্র ২২ বয়েছের একটা “বাচ্চা’ কে চম্বলে পাঠানো সম্ভব নয় ধীরেনদার পক্ষে। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে পিতৃসম। তাই মৃদুলদাকেই সবকিছু খুলে বলা উচিত মনে করলাম।
দুপুরে অফিসে গিয়ে মৃদুলদাকে বাইরে ডেকে সব খুলে বললাম। মৃদুলদা অবাক হয়ে বললেন, তুই তো জ্যাকপট মেরে দিয়েছিস? অভিশপ্ত চম্বলে যাবার টিকিট পেয়ে গেছিস? আমি বললাম, না এখনো পাইনি। মা না বললে, ভিসা বিজুদার কাছেই থাকবে। আমার হাতে আসবে না।
মৃদুলদাকে কান্না মেশানো গলায় অনুরোধ করলাম, দাদা আজ রাতে আমার বাড়িতে যাবে? মাকে তুমি বললে মা না করবে না। প্লিজ বোলো যে তুমিও যাবে, তাহলে মা কিচ্ছু বলবে না। মৃদুলদা রাজী হয়ে গেলেন। মৃদুলদা আর আমি দুটো স্টেশন আগে পরে থাকি। কোন্নগর আর শ্রীরামপুর।
মৃদুলদা সে রাত্রে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন। মাকে কথা দিয়েছিলেন তিনিও যাবেন। মা রাজি হয়েছিলেন। ব্রেভ লেডি। মার হাত ধরেই একবার “অভিশপ্ত চম্বল” দেখতে গিয়েছিলাম। মা’র নিশ্চয় সেই স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল।  তবু সাহসিনী মা রাজী হয়ে গেলেন। ফিরে আসার সময় মৃদুলদাকে চুপি চুপি বলেছিলেন, তোমার এই ভাইটি কি এই সব হাবিজাবি কাজই করবে না চাকরি করবে? চাকরি বাকরি না করলে পোলাটার বিয়া দিমু কেমনে?
পরের দিন দুরু দুরু বক্ষে মৃদুলদার সঙ্গে ধীরেনদার ঘরে ঢুকলাম। সবিস্তারে সব শোনার পরে শুরু হল তার সম্পাদক সত্তা বনান পিতৃসত্তার লড়াই। তারপর কিছুক্ষন কী যেন ভাবলেন। বললেন, এই মিশনের লিডারশিপ দেবে মৃদুল। তুমি সহকারী। এই বয়েসের একটা ছেলেকে আমি মৃত্যুপুরিতে একা যেতে দিতে পারি না। তুমি যতই সিগারেট ফোকো না কেন এখনো ততটা বড় হওনি। মৃদুলদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাকাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে টেক কেয়ার অফ ইয়োর কমরেড।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে ১ হাজার ২০০ টাকা মৃদুলদার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধীরেনদা বলেছিলেন, চেষ্টা কর এই টাকায় চালিয়ে নিতে। ফুরিয়ে গেলে একটা ঠিকানা পাঠিও, মানি অর্ডারে টাকা পাঠিয়ে দেবো।
তারপর?
তারপর ‘ তুফান মেল’. গন্তব্য আগ্রা।
ক্রমশ। ….

Related Posts

Leave a Reply