সাঁড়াশি আক্রমণে দুর্ভোগই সম্ভাব্য নিত্যসঙ্গী ভারতের
কলকাতা টাইমস :
ক্রমশই তেতে উঠছে বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর। তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বাড়ছে। আগামী দিনে সেই আশঙ্কা আরও বাড়বে। চলতি শতাব্দীর শেষে ভারতীয় উপকূলে সমুদ্রতলের উচ্চতা-বৃদ্ধি ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। সবমিলিয়ে সমুদ্রের দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে বারবার নানা ভাবে দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে ভারতের। অন্যতম দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ বেড়ে যাওয়া।
মঙ্গলবারই দেশের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রথম মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে ভূবিজ্ঞান মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের আইপিসিসি-র ঢঙে তৈরি হয়েছে এসিসিআইওআর: অ্যাসেসমেন্ট অফ ক্লাইমেট চেঞ্জ ওভার ইন্ডিয়ান ওশন রিজিয়ন।
রিপোর্টটি তৈরি করেছেন পুনের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির (আইআইটিএম) বিজ্ঞানীরা। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের অতীত আলোচিত হয়নি, দেওয়া হয়েছে আগামী দিনের আভাসও। তাতেই একরাশ দুশ্চিন্তা।কিছু দিন আগে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ধাক্কা সয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। আম্ফান ১৯৯৯ সালের পর বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া প্রথম সুপার সাইক্লোন। তার পরের নিসর্গও তীব্র ঘূর্ণিঝড়। তথ্য বলছে, গত চার বছরের ২০টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ১৫টিই তীব্র, অর্থাৎ ৭৫%। এসিসিআইওআর রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি শতকে, বিশেষ করে বর্ষা পরবর্তী সময়ে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। যেমন, গত বছর আরব সাগর স্বাক্ষী হয়েছিল সুপার সাইক্লোন কিয়ারের।
বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, এর অন্যতম কারণ উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। রিপোর্ট বলছে, ১৯৫১-২০১৫, এই পর্বে ভারত মহাসাগরের জলতলের তাপমাত্রা গড়ে অন্তত এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। যা দুনিয়ার গড়ের (০.৭ ডিগ্রি) চেয়ে বেশি। সমুদ্রে জমানো তাপশক্তির পরিমাণও বাড়ছে। গত দু’দশকে যার বৃদ্ধি হঠাৎই অনেকটা বেশি। জলতলের তাপমাত্রা এবং সমুদ্রের তাপশক্তির ভাণ্ডার, দুই-ই আগামী দিনে বাড়বে, জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় বড়সড় ছাপ পড়ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে। ২০১৮ পর্যন্ত অতীতের ১১৮ বছরে দেশের গড় তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি গরম বাড়ছে বর্ষার আগে। দাপুটে গরমের এই প্রবণতা মূলত বেড়েছে ১৯৮৬ সালের পর। পূর্বাভাসে আশঙ্কা অনেক। চলতি শতকের শেষে গড় তাপমাত্রা ৪.৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। উষ্ণ দিন এবং উষ্ণ রাত, দুয়ের সম্ভাবনাই ঊর্ধ্বমুখী।
গোটা বিশ্বেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে স্থল এবং সমুদ্র, সর্বত্র বরফ গলছে। তার সঙ্গে বাড়ছে জলতলের উচ্চতা। সমুদ্রতল যত উঁচু হবে, তত বিপত্তি বাড়বে সুন্দরবনের মতো বাঁধবেষ্টিত অঞ্চলের। ঘূর্ণিঝড় এবং ভরা কোটালের ‘নির্ঘণ্ট’ মিলে গেলে ক্ষতির বহরও বাড়বে।
আইআইটিএম-এর জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথু কল বলেন, ‘চরম ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু দু’টি চরম ঘটনা একসঙ্গে ঘটলে ক্ষতি ভয়ানক হবে। এবং সেটাই চিন্তার। যেমন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় বৃষ্টির তীব্রতা এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস দুই-ই বাড়ছে। খরা এবং তাপপ্রবাহ একইসঙ্গে হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পরবর্তী মূল্যায়নে এই সাঁড়াশি হামলার বিষয়েও জোর দেওয়া প্রয়োজন।’
রিপোর্টের অন্যতম সম্পাদক, আইআইটিএম-এর অন্তর্গত সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চের বিজ্ঞানী সুপ্রিয় চক্রবর্তী বলেন, ‘ভূবিজ্ঞান মন্ত্রণালয় থেকে আইপিসিসি-র মতো করেই আঞ্চলিক রিপোর্ট তৈরি করতে বলেছিল আমাদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রবণতার সঙ্গে মিলে গেলেও কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক তারতম্য দেখতে পেয়েছি আমরা। যেমন, ১৯৫১-২০১৫, এই ৬৫ বছরে দেশে ৬% বৃষ্টিপাত কমেছে বর্ষায়। বিশ্বে বৃষ্টির প্রবণতা অবশ্য উল্টো।’
তবে এ দেশেও মুষলধারায় ভারী বর্ষণ হচ্ছে। ফলে খরা যেমন হচ্ছে, আবার বিপদ বাড়িয়ে বন্যাও হচ্ছে। দুর্যোগ ও দুর্ভোগই সম্ভাব্য নিত্যসঙ্গী!