ইধার ডাকু কো ডরনা নেহি, হাম সব ডাকু হ্যায়। লেকিন …

আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ৭)
সৌগত রায়বর্মন: সব কিছু রেডি করে বেরতে বেরতে প্রায় সাড়ে ছ’টা বেজে গেল। সূর্য তখন থেকেই বদ্ধ পরিকর যে আমাদের পুড়িয়ে মারবে। নইলে সকালেই তিনি যে মেজাজে আছেন তাতে বেলা বাড়লে যে কী অবস্থা হবে তা ভাবতেই গা যেন শিউরে উঠতে লাগল।
রামসুন্দর কিন্তু কথা রেখেছে। বিন্ধ্য পর্বতের সানুদেশে এসে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। পনেরো জনের একটা আর্মি আমাদের এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে, এ কথা কল্পনাও করতে পারি না, আজও। দুই বাঙালি বীরপুরুয সামনের ওই অরন্য পেরিয়ে যাচ্ছে ডাকাতের ডেরায়, বাপের জন্মে কোনও দিন ভাবিনি তা সত্য হতে পারে।
বুন্দেলখন্ড জঙ্গল কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে খাড়াই উঠে গেছে। পাহাড়ে ওঠা ছাড়া ওই জঙ্গলে প্রবেশ সম্ভব নয়।
নুড়ি পাথর আর বেলে মাটির পথ চলে গেছে জঙ্গল চিরে। রাস্তা বলে কিছু নেই, যা আছে তাকে পায়ে চলা পথ বলা যেতে পারে। কখনো বোঝা যায়, কখনো যায় না। চিনে নিতে হয়।
আমরা ঠিক মাঝখানে। সামনে বাহিনী, পিছনে বাহিনী।
প্রথম ১০ মিনিট চলার পরেই মনে হল আর পারবো না। ২৪ বছর বয়েসেই বিড়ি-সিগারেট খেতে খেতে দমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি। তখন জানতাম না, একদিন বুন্দেলখন্ড জঙ্গলে উঠতে হবে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে। দিব্য তুলনায় অনেক ফিট। আমাদের সামনের বাহিনী অনেকদুর এগিয়ে গেছে। হয়তো ডাকুজির খবর করতে। রামসুন্দর সেই দলে।
আমরা যাদের সঙ্গে যাচ্ছি তাদের সঙ্গে গল্প গুজব করতে করতে এক সময় দেখলাম, আমাদের কষ্ট অনেকটাই কেটে যাচ্ছে। পরবর্তী কালে পাহাড়ে ওঠা আমার নেশা হয়ে উঠেছিল। তখন দেখেছিলাম, প্রাথমিক কষ্টটা মানিয়ে নিতে পারলে চড়াই ভাঙ্গা খুব একটা অসাধ্য কর্ম নয়।
আমাদের কমরেডদের কাছ থেকে শুনলাম, আমরা আসলে যাচ্ছি জলের খোঁজে। কেননা এই প্রবল জঙ্গলময় পাহাড়ে জলের উৎস খুব কম। তার মানে যেখানে জল পাওয়া যাবে সেখানেই ডাকুদের শিবির ফেলার সম্ভাবনা বেশি।
ডাকুরা সাধারনত এক জায়গায় দু রাত্রী বাস করে না। একটা জলের উৎস থেকে আরেকটা জলের ঠিকানায় পৌছে যায়। তাদের জিপিএস বোঝা পুলিশের পক্ষে তাই অসম্ভব। একমাত্র ভরসা মুখবির বা গুপ্তচর।
মুখবির শব্দটা শুনেই বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠল। রামসুন্দরের কাছে আমাদের পাঠিয়েছে পুলিশ লাইনের সুখবিন্দর। তারমানে রামসুন্দর কোন পক্ষে? পুলিশ না ডাকাত? প্রশ্নটা কাকে করবো?
দিব্যকে কথাটা ফিঁসফিঁস করে বললাম। দিব্য গম্ভীর ভাবে বলল, ডবল এজেন্ট।
দিব্য যা বলে তা আমি গুরুবাক্য হিসেবে মেনে নেই। ইকনমিক্সে যে থার্ড হতে পারে সে যে আমার থেকে বুদ্ধিমান সে বিযয়ে আর যারই সন্দেহ থাক, আমার অন্তত নেই।
ডবল এজেন্ট ব্যাপারটা কী তা ততদিনে জেনে গেছি। জেমস বন্ডের দু তিন খানা ছবি দেখাও হয়ে গেছে।
আমার শুকনো মুখের দিকে বিজ্ঞের মত দিব্য বলল, রামসুন্দর আসলে নিজেই একটা ডাকাত। তবে ছোট খাটো। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে ডাকুদের মামুলি কিছু খবর দেয়। আসল খবর যে ও দেয় না, তা তুই লিখে নিতে পারিস। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে ও পুলিশের গতিবিধির খবরও ডাকুদের কাছে পৌছে দেয়।
আমি হতবাক। বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, তবে আমাদের এখানে নিয়ে এলো কেনো?
দিব্য একটু ভেবে নিয়ে বলল, আইজিকে খুশি করার জন্য। তোর কি ধারণা পুলিশ আমাদের খবর রাখছে না? নিচে নামলেই তা টের পাবি!
এতক্ষন গতরাতের ভাংগের নেশায় এতদুর উঠে এসেছি। কষ্টটা এনজয় করেছি। দিব্য-র কথা শুনে চোখে হলুদ ফুল দেখতে লাগলাম। ভীযন জল পিপাসা পেয়ে গেল। দিব্যর দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলে উঠলাম, ওদের একটু দাঁড়াতে বল, জল খাবো।
দলের সবাই আমার আর্জি মঞ্জুর করল। আমরা একটা ঢালের গায়ে বসে পড়লাম। মাথার ওপর নাম না জানা বিরাট-বিরাট গাছের ছায়া।ভিস্তি থেকে ঠান্ডা জল আর শুকনো মক্কাইয়ের রোটি খেয়ে প্রায় এক প্যাকেট চারমিনার শেয করে দিলাম। বুঝলাম ফাঁটা বাঁশে শরীরের কিছু অংশ আটকে গেছে।
যা হবার তা হবে, এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
প্রায় আধঘন্টা বিশ্রাম নেবার পর আমাদের দলের এক সদস্য বলে উঠল, চলিয়ে ভাইসাব। এক জায়গা মে ইতনা টাইম রুকনা ঠিক নেহি হ্যায়।
আমি উত্তেজনায় বলে উঠলাম, কিউ, ডাকু লোক আয়েগা?
আমার প্রশ্ন শুনে সে সারা জঙ্গল কাঁপিয়ে হেসে উঠল। বলল, ইধার ডাকু কো ডরনা নেহি। হাম সব ডাকু হ্যায়। লেকিন জানোয়ার হ্যায়। ডাকু সে জানোয়ার জাদা খতরনাক হ্যায়।
সুতরাং আবার পথ চলা। চল, না বলে ওঠা ভালো। চারদিক নিঃশব্দ। গরম হাওয়া যেন গাছের গায়ে গা ঘষে একটু ঠান্ডা হয়েছে। কিছু পাখির আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসছে।
নিজের বুকের আওয়াজ নিজেই শুনতে পাচ্ছি। কখনো লতানো গাছ, কখনো বড় গাছের ডালপালা আকড়ে আমরা যাচ্ছি।
হঠাৎ একটা পোড়া গন্ধ নাকে এলো। হালকা কিন্তু স্পষ্ট।
আমার হঠাৎ মনে হল, দাবানল নয় তো ! মুশকিলটা হল দাবানলের কোনো হিন্দি আমাদের জানা ছিলি না। ভয়ে ও ভাবনায় একজনকে জিজ্ঞেশই করে ফেললাম, জঙ্গল জ্বলতা হ্যায়? লোকটা হেসে বলল, আর দো কদম আগে গেলে নিজেরাই দেখতে পাবেন।
মনে অজস্র প্রশ্ন নিয়ে আরো একশো ফুট উঠতে হল।\
-ক্রমশ