হঠাৎ মুখ যদি যায় বেঁকে…
নিশ্চয়ই ঘাবড়ে গেছেন। ঘাবড়ানোর কিছুই নেই। এরকম সমস্যায় যদি কেউ পড়েন তবে বুঝতে হবে আপনার মুখের নার্ভে এমন কোনো সমস্যা হয়েছে যার ফলে আপনার মুখের মাংসপেশি তার স্বাভাবিক কাজকর্মের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। যাকে ডাক্তারি ভাষায় ফেসিয়াল বা বেল্স পলসি বলে বা মুখ অবশ রোগ নামে খ্যাত।
মানুষের মুখমণ্ডল এক বিশেষ ধরনের মাংসপেশি দ্বারা তৈরি যার সাহায্যে মানুষ মুখের মাংসপেশির সংকোচন ও প্রসারণ দ্বারা কথা না বলেও মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, এ জন্য একটি শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে যার নাম মূকাভিনয় শিল্প। মুখমণ্ডলে মানুষের সৌন্দর্য ও দৈনন্দিন কাজের সুবিধার জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অঙ্গ যেমন- মুখ, নাক, চোখ, কপাল, কান ইত্যাদি স্থাপন করেছেন এ অঙ্গের সাহায্যে মানুষ তার পরিচিতসহ খাওয়া-দাওয়া, কথা বলা, শ্বাস গ্রহণ করা, দেখা, শোনার মতো গুরুত্ব কাজ সম্পন্ন করেন।
এসব কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য মুখে কিছু সংখ্যক নির্দিষ্ট মাংসপেশি স্থাপন করা হয়েছে এবং ওই সব মাংসপেশিকে আদেশ-নির্দেশ প্রদানের জন্য মগজ থেকে কানের পাশ দিয়ে নেমে সপ্তম ক্রেনিয়াল বা ফেসিয়াল নার্ভ পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মুখমণ্ডলে বিভিন্ন মাংসপেশিকে সচল রাখে। কোনো কারণবশত ওই মস্তিষ্কের ক্রেনিয়েল বা ফেসিয়াল নার্ভে প্রদাহ, প্রতিবন্ধকতা বা যদিও আঘাত পেলে নার্ভ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
যদিও ফেসিয়াল পলিসির সঠিক কারণ নির্ণয় অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। তবে ফেসিয়াল নার্ভের-ভাইরাস আক্রমণ, অতিরিক্ত ঠান্ডা আঘাত, স্ট্রোক-এসব কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। স্বাভাবিক কাজকর্মের কী কী প্রধান মাংসপেশি এবং তার কাজ কী?
১। অক্সিপিটর ফ্রন্টালিস-ব্রু ওপরে উঠায়,
২। করোগেটর ও প্রসেসিস-ব্রু কুঁচকায়,
৩। অরবিকুলার অকুলি চোখ বন্ধ করে,
৪। জাইগো মেট্রিক-মেজর ও মাইন (ওপরের ঠোঁটসহ মুখের কোনা ওপরে উঠায়), ৫।বাক্সিনেটর-গাল ফুলায়, চুষতে সহায়তা করে। হঠাৎ করেই এ রোগে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত হওয়ার আগে অনেক সময় মাথাব্যথাসহ আক্রান্ত পাশের কানের গোড়ায় ব্যথা হতে পারে এবং এর পর হঠাৎ করেই আক্রান্ত পাশের চোখ বন্ধ করতে, কপাল কুঁচকাতে বা ওপরে তুলতে, থুথু ফেলতে, পানি পান করতে, এ ছাড়া কখনো কখনো খাবার-দাবার চিবাতে অসুবিধাসহ মুখ একদিকে বেঁকে যেতে পারে।
কারণ : ভাইরাসের সংক্রমণ হলে (হার্পিস সিমপ্লেক্স, হার্পিস জোস্টার, ইপস্টাইন বার ভাইরাস, সাইটোমেগালো ভাইরাস, অ্যাডিনো ভাইরাস, রুবেলা ভাইরাস, মাম্পস ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস।) মধ্যকর্ণে কোনো ইনফেকশন বা সংক্রমণ হলে। ঠান্ডা বা আঘাতজনিত কারণ। মস্তিষ্কের স্ট্রোক। মাথায় আঘাত পেলে। ফেসিয়াল টিউমার হলে।
কান বা প্যারোটিড গ্রন্থির অস্ত্রোপচারে যদি ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি হয়। ডায়াবেটিস থাকলে। শ্বাসযন্ত্রের রোগ। ঠান্ডা, ঘা বা যৌনাঙ্গে হারপিস।
চিকিৎসা : যেহেতু এটি স্নায়ুবিক সমস্যা সৃষ্ট মাংসপেশির অবশতা, তাই এর চিকিৎসার অন্যতম ভূমিকা হলো ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন। এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে একজন নিউরো বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো প্রয়োজনবোধে স্টেরয়েড, ভিটামিন এবং পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হবে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় সাধারণত ইলেকট্রিক নার্ভ ইস্টিমুলেশন প্রদাহ কমানোর জন্য আলট্রাসাউন্ড থেরাপিসহ পদ্ধতিগত চিকিৎসা থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ উপকারী।
ব্যায়ামগুলো যেমন : ১। জোর করে চোখ মারার চেষ্টা করা। ২। শিশ বাজানোর চেষ্টা করা। ৩। ঠোঁট চেপে ধরে গাল ফুলানোর চেষ্টা করা। ৪। কপাল কুঁচাকানো। ৫। ভ্রু কুঁচকানো ইত্যাদি। ৬। আলতো করে আক্রান্ত গালে সার্কুলেটরি মুভমেন্ট করা। এ ছাড়া শক্ত খাবার আক্রান্ত গালে খেতে হবে এবং অতিরিক্ত ঠান্ডা খাওয়া বা লাগানো পরিহার করতে হবে। এসব রোগীর চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হয়। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ফেসিয়াল প্যারালাইসিস রোগের একমাত্র এবং মূল চিকিৎসা। তাই এসব বিষয়ে আমাদের আরও যত্নবান হতে হবে।