সৌগত রায় বর্মন
‘ জেন’ জাপানের একটি প্রাচীন ধর্ম। কেউ কেউ মনে করেন, জেনরা বুদ্ধদেবের আদর্শ অনুসারী। আবার অনেকেই বলেন, জেনরা চিণের কনফুসিয়াসের দর্শনের সঙ্গে বুদ্ধের চিন্তা মিশিয়ে একটা নতূন পথ সন্ধান করেছিলেন। জেনরা কিন্তু ঈশ্বর প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের মতোই নিশ্চুপ ছিল।সুতরাং তারা আস্তিক না নাস্তিক তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। তাদেরকে ঠিক ধর্ম বা বোলে বরঞ্চ জীবনধারাও বলা যেতে পারে। আশ্চর্য এটাই যে তাদের কোনো ধর্ম পুস্তকই নেই। তাদের যা কিছু বক্তব্য সবই গল্পের আকারে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত। আজ থেকে প্রায় হাজার দু হাজার বছর আগে লেখা এই চার ছ’ লাইনের কাহিনিগুলি ক্রমশ লোক মুখে চলতে চলতে যে কয়েকটা এখন পাওয়া যায় তার কয়েকটি নিদর্শন নিচে দেওয়া হল।
১ সাধু ও সুন্দরী
দুই তরুন সাধু, বিশেয কাজে পাহাড় পেরিয়ে আরেক মঠে যাবে বলে ভোর বেলা রওয়ানা হল। ঘন জঙ্গল, খরস্রোতা নদি, পাহাড়ি পথে যেতে যেতে তারা একটি নদির পাশে এসে দাঁড়াল। দেখতে পেল এক অপূর্ব সুন্দরী নারী নদির সামনে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। দুজনেই কী করবে বুঝতে না পেরে মেয়েটির কাছে এসে বলল, তুমি কাঁদছ কেন? মেয়েটি অস্রুসজল চোখে বলল, আমি নদির ওপারে যাবো। আমার ভাই খুব অসুস্থ, জেতেই হবে। কিন্তু নদির স্রোত এতই তীব্র যে পার হতে পারছিনা।আমাকে তোমরা পার করে দেবে? তরুন সাধুদের একজন তৎক্ষনাত মেয়েটিকে কাধে নিয়ে অনায়াসে নদি পার হয়ে গেল। ওপারে পৌঁছে মেয়েটিকে নিরাপদ স্থানে নামিয়ে দিয়ে গন্তব্যের দিকে চলতে লাগল। সঙ্গে আরেক সাধু। সে চুপচাপ ঘটনাটি দেখেছে কিন্তু কোনো কথা বলেনি। বাকি রাস্তাতেও সে ছিল মৌন । প্রায় সন্ধের মুখে তারা মঠে ফিরে এসে, আহার গ্রহন করে নিদ্রার প্রস্তুতি করার সময় যে সাধু এতক্ষন কোনো কথা বলেনি সে তার সঙ্গীকে প্রশ্ন করল, ভাই আমাদের শাস্ত্রে কোনো নারীকে ছোঁয়া বারন। তুমি তাই করলে, মেয়েটিকে কাধে করে বয়ে নদী পার করলে! এটা কি ঠিক হল? অন্য সাধু উত্তর দিল, আমি তো মেয়েটাকে ওখানেই নামিয়ে দিয়েছি। তুমি তাকে এখনো বহন করে বেড়াচ্ছো?
২ জীবন যে রকম
একজন ঘোড়া ব্যবসায়ীর আস্তাবলে ছিল অনেক ঘোড়া। একদিন সকালে উঠে দেখা গেল দশটা ঘোড়া পালিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী ব্যবসায়ীকে সান্তনা দিতে এলো। তারা হায় হায় করে বলে উঠল,কী দুঃখের কথা। একটা নয় দুটো নয়। দশটা ঘোড়া পালিয়ে গেল। তোমার সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। ব্যবসায়ী কিছু না বলে মাথা নেড়ে বলল, হতে পারে।
পরের দিন দেখা গেল ওই দশটা ঘোড়া আরো দশটা বুনো ঘোড়াকে নিয়ে এসেছে। পাড়ার লোক বাহবা বাহবা দিয়ে তাকে বলল, কী ভাগ্য তোমার? গেল দশটা, এলো কুরিটা। একেই বলে ভাগ্য! লোকটা আস্তে বলল, তা হতে পারে।
পরের দিন লোকটার ছেলে বুনো ঘোড়াকে পোয মানাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পা ভাংল।পাড়ার লোক এসে সান্তনা দিয়ে গেল, কী খারাপ সময় যাচ্ছে তোমার! তোমার বয়েস হয়েছে, এদিকে ছেলের পা ভাংল। এবার এই ব্যাবসাকে দেখবে? বড্ড খারাপ সময়, সাবধানে থেকো।
পরের দিনই রাজার লোক লোকলস্কর এসে হাজির। য়ুদ্ধ লেগেছে, সৈন্য চাই। গ্রামের য়ুবকদের সেনাদলে ভর্তি করা হবে। ব্যবসায়ীর ছেলের তো ভাঙা পা। তার দিকে সেনারা তাকিয়েও দেখলো না।
পরের দিন প্রতিবেশীরা আবার এলো। বলল, কী সৌভাগ্য তোমার! ভাগ্যিশ ছেলের পা ভেঙে ছিল! লোকটি সেই একই কথা বলল, হবে হয়তো।