পেসমেকার, ইমপ্ল্যান্টের দৌলতে দশ বছরে মৃত ৮৩ হাজার

কলকাতা টাইমস :
পেসমেকারসহ শরীরের ভিতরে লাগানোর বিভিন্ন যন্ত্রের ত্রুটির কারনে গত এক দশকে ৮৩ হাজার মানুষ মারা গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এসব যন্ত্র বা ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করে সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আহত হয়েছে অন্তত ১৭ লাখ মানুষ।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজি)-এর অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসছে। ৩৬টি দেশের ৫৯ সংবাদমাধ্যমের ২৫০ জনেরও বেশি সাংবাদিক এক বছর ধরে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করেন।
বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী পানামা পেপার্সও প্রকাশ করেছিল আইসিআইজি। ওই প্রতিবেদনের জন্য সাংবাদিকতায় সম্মানজনক পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেয় তারা।
‘ইমপ্ল্যান্ট ফাইল’ নামের প্রতিবেদনটি তৈরির সময় শরীরের ভিতরে লাগানো যন্ত্রের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ৫০ লাখ অভিযোগ পর্যালোচনা করেন সাংবাদিকরা।
এই সময়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান মেডিট্রনিকের তৈরি পেসমেকারসহ বিভিন্ন যন্ত্রের বিষয়ে। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রের প্রতি পাঁচটি অভিযোগের একটি তাদের বিরুদ্ধে। চিকিৎসা যন্ত্রে ত্রুটির গ্রহণযোগ্য হারের তুলনায় এটি অত্যন্ত বেশি।
সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীদের শরীরে লাগানোর বিভিন্ন যন্ত্র, যেমন: গর্ভনিরোধক কয়েল, যোনিপথে লাগানোর বিশেষ জালিকা (mesh), ও স্তনের ইমপ্ল্যান্ট।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি জানায়, ইমপ্ল্যান্ট সাধারণত উপকারী হলেও, অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর কারনে রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন কয়েকটি যন্ত্রের উদাহরণ হিসেবে বিবিসি জানায়:
– অনেক ইমপ্ল্যান্ট মানুষের পিঠেই ভেঙ্গে যায়। এগুলো আগে বেবুন বা বানরের ওপর পরীক্ষা করার সময়ও ব্যর্থ হয়েছিল।
– গর্ভনিরোধক ইমপ্ল্যান্ট শরীরের ভিতরে বিভিন্ন ক্ষতি করে এবং রক্তপাত ঘটায়।
– হৃৎপিণ্ডের গতি নিয়ন্ত্রণে লাগানো যন্ত্র (defibrillator) ঠিক মতো কাজ না করা।
– শরীরের ভিতর লাগানো জালিকার কারনে পেটে ব্যথা হওয়া।বিবিসি আরও জানায়, মেরুদণ্ড প্রচণ্ড রকম বাঁকানো বা এমন শিশুদের চিকিৎসায় যে যন্ত্রটি লাগানো হয় সেটি শুধু শুয়োর ও মৃতদেহের ওপর পরীক্ষা করেই বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয়।
এদিকে ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা জানায়, মেডিট্রনিক ভারতের সবচেয়ে বড় হৃদরোগ হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞদের ঘুষ ও ঋণ দিয়ে তাদের যন্ত্রের বিক্রি বাড়িয়েছে। এমনকি রোগীদেরও ঋণ দিয়ে আকৃষ্ট করছে তারা।
মেডিট্রনিকের সিইও ভারতকে তাদের পণ্যে ঢেলে দেয়ার জন্য ‘সবচেয়ে বড় গর্ত’ হিসেবে অভিহিত করেন, জানায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিয়াক সার্জনদের সবচেয়ে বড় সম্মেলনগুলোর স্পন্সর হতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠানটি।
মেডিট্রনিক ভারতের ২৫টি শহরে দরিদ্র রোগীদের কাছে বিভিন্ন যন্ত্র বিক্রির প্রকল্প চালিয়ে ‘বিশাল অঙ্কের লাভ’ করে, জানায় কর্তৃপক্ষ। এরপর তারা গত বছর ‘স্বাস্থ্যখাতের পরিস্থিতি পাল্টে গেছে’ এই অজুহাতে কার্যক্রমটি বন্ধ করে দেয়।
তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, ও পোল্যান্ডে মেডিট্রনিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। তবে ছয় বছর ধরে তদন্তের পরও তারা কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।
বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা রোগীদের এসব যন্ত্রের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এগুলো বাজারে ছাড়ার আগে ঠিক মতো পরীক্ষা করা হয় না। রোগীদেরকে এসব ব্যবহারে উৎসাহিত করতে ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিভিন্নভাবে ঘুষ দেয়া হয়।
জাপান, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়াতে মেডিট্রনিককে সবচেয়ে বেশি ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা যন্ত্র নির্মাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
শরীরের ভিতরে লাগানোর বিভিন্ন যন্ত্র নির্মাতারা ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে দুর্নীতি, প্রতারণা ও অন্যান্য নিয়মভঙ্গের মামলায় ১৬০ কোটি ডলার দিয়ে আপোষরফা করেছে।
২০১৫ থেকে জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রের কারনে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের ৪৩০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আইসিআইজি’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কিছু মেডিক্যাল ডিভাইসকে খুব দ্রুত অনুমোদন দেয়া হয় রোগীদের ওপর ব্যবহারের জন্য। আবার অনেক ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র হাসপাতাল থেকে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে ফেলে দেয়া হয় না।
ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালিতে মেডিট্রনিকের দুর্নীতির অভিযোগেরও বিভিন্ন তদন্ত চলছে।
মেডিট্রনিক ডায়াবেটিস, পুরনো তীব্র ব্যাথা, পারকিনসন্স ডিজিজসহ বিভিন্ন অসুখ উপশমের যন্ত্র তৈরি করছে। ভিটামিন পিলের সমান তারবিহীন পেসমেকার তৈরি করেছে তারা। এখন অপারেশন রুমের যন্ত্র তৈরি ও রোগীদের পর্যবেক্ষণের যন্ত্র তৈরি শুরু করেছে তারা।