November 12, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular রোজনামচা

করোনা আক্রান্ত ফ্রান্স থেকে 

[kodex_post_like_buttons]
সৌরভ মুখাৰ্জী, প্যারিসঃ 
চীন, ইরান, ইতালি তারপর ফ্রান্স। আমি এখন ফ্রান্সের যে জায়গাটায় বসে আছি সেই জায়গাটা সমস্ত দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে। প্যারিসের দক্ষিণে একটা জমজমাট জায়গা। জমজমাট ছিল একসময়, এখন আর নেই।
 
আমার সামনে কাঁচঢাকা জানলা, জানলার কাঁচ প্রায় পাঁচদিন ধরে খুলিনি। জানলার ওপারে ব্যালকনি যেখানে না গিয়ে গিয়ে রেলিংয়ে ধুলো জমে গেছে। ব্যালকনির পরে রাস্তা। দক্ষিণ প্যারিস ও শহরতলীর মূখ্য রাস্তা যেখান দিয়ে সর্বক্ষণ গাড়ি, বাইক, সাইকেল আর মানুষের ভিড় লেগে থাকতো। সিগন্যাল লাল হলে সারি সারি গাড়ির লাইন পড়ে যেত। জানলার ঠিক ওপারে ব্যস্ত রেল স্টেশন, সর্বক্ষণ মানুষজনের ভিড় লেগে থাকতো। গোটা রাস্তা জুড়ে রেস্তোরাঁ, ছোট বড় খাবারের দোকান যেখানে সন্ধ্যে হলেই লোক গমগম করতো। সব জায়গায় এখন নিস্তব্ধতা। যেন রাত দেড়টা বাজে, হয়তো বা আরও গভীর।
 
যে দুএকজনকে দেখা যাচ্ছে তাদের মুখ ঢাকা মাস্কে। গাড়ি যাচ্ছে না বললেই চলে, হ্যাঁ যাচ্ছে কিছু অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ি। মানুষ চাইছে মানুষের থেকে দূরে থাকতে। জানলার বাইরে তাকালে মনে হচ্ছে সায়েন্স ফিকশনের কোনো হলিউডি সিনেমা দেখছি। যে মানুষটা আগের সপ্তাহেও নিজের চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, প্রেম বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, সম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল সে এখন শুধু ব্যস্ত নিজের প্রাণ বাঁচাতে।
 
ফ্রান্স গভর্নমেন্ট যুদ্ধকালীন অবস্থা জারি করেছে। গ্রোসারি আর ফার্মাসি ছাড়া সব দোকান বন্ধ। কয়েকঘন্টা লাইন দিয়ে একপ্যাকেট পাউরুটি পাওয়া যাচ্ছে। এমার্জেন্সি খাবার বা ডাক্তার দেখানো ছাড়া কেউ বাইরে বেরোতে পারছে না। বেরোলেও গভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া একটি ফর্ম ফিলআপ করে সঙ্গে রাখতে হবে। রাস্তায় টহলরত পুলিশ দেখতে চাইছে, সন্তোষজনক উত্তর না পেলে ১৩৫ ইউরো ফাইন অথবা জেল।
 
সকালে আমার ঘরের ঠিক নিচেই গাড়ি থেকে নামলো একজন মহিলা ও তার বছর দশেকের ছেলে। এখনো অবধি বাইরে ওই দুটি প্রাণীর দেখাই পেয়েছি। দুজনেরই মুখে সাদা মাস্ক। চোখে আতঙ্ক। অ্যাপার্টমেন্টের কর্মচারীরা ছুটিতে চলে গেছে। হোটেলের বেশিরভাগ ঘর খালি হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরের দরজা বন্ধ করার লোকটুকু পর্যন্ত নেই। দিনের পর দিন খোলা পড়ে আছে।
 
পাশের দেশ ইতালির অবস্থা আরো খারাপ। কবর দেওয়ার লোক পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। ইতালিতে এক একদিনে পাঁচশোর কাছাকাছি লোক মারা যাচ্ছে। ইরানে গণকবর খোঁড়া হচ্ছে। যতদিন চীনে এরকম হচ্ছিল, খবর পাচ্ছিলাম উহান প্রদেশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে ততদিন ইউরোপে বসে ভারতে বসে আমরা সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি। তাই আজ ইউরোপের এই অবস্থা। মাত্র একমাসের ব্যবধানে। এখন আমাদের দরজার দাঁড়িয়ে আছে মারণরোগ। মানুষ বিষাক্ত, বাতাস বিষাক্ত, হয়ত বা শরীরও বিষাক্ত হয়ে গেছে এতক্ষনে। জানতে না দিয়েই। 
 
না আতঙ্ক ছাড়ানোর জন্য লিখছি না। ইতালি যে ভুল করেছিল ভারত সে ভুল যেন না করে। শুধু টিভি বা খবরের দর্শক হয়ে নয়, কিছু করার আবেদন এটা। হোয়াটস্যাপ বা ফেসবুকের ভুয়ো খবর নয়, বরং সচেতনতা ছড়ান। পরিসংখ্যান বলছে ভারতে মাত্র দুই সপ্তাহ যদি আমরা ঘরবন্দি হয়ে থাকি তাহলে আমাদের অবস্থা ইতালি বা ফ্রান্সের মত হবে না। ইতালি ইরান ফ্রান্স অনেক দেরিতে করেছে, ভারতীয়দের হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। দুই সপ্তাহ ঘোরা-বেড়ানো বা অদরকারি কাজগুলোকে মুলতুবি রাখুন। একসপ্তাহ ছুটি কাটান ঘরে বসে, অযথা দোকান বাজার ছোটাছুটি করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। এই এক দু সপ্তাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুসপ্তাহ পর হয়ত সেলফ কোয়ারেন্টাইনের আর কোনো প্রয়োজনীয়তাই থাকবে না। প্রকোপ একেবারে কমে যেতে পারে, নইলে হয়ত ঘরে বসে বসেও আক্রান্ত হতে পারেন।
 
আসুন, আমরা আগামী দু-সপ্তাহ মাত্র তিনটে কাজ করি। বেশি না, তিনটে কাজ-
 
#এক, বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিই। বন্ধ মানে বন্ধ। পাড়ার দোকানটুকুও নয়। আত্মীয় বন্ধু প্রতিবেশী কারোর বাড়ি যাবেন না, তাদেরও নিজের বাড়িতে ডাকবেন না। যেখানে ভিড় বেশি, কুড়ি জনের বেশি লোক জমায়েত হয়েছে সে জায়গা এড়িয়ে চলুন, সে শপিং মল হোক কি ধর্মীয় স্থান। দুসপ্তাহ সেদ্ধ ভাত খেয়েই চালিয়ে নিই। চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ  মজুত আছে এতদিনে। বিরিয়ানি মশলা কিনতে না বেরোনোর প্রতিজ্ঞা করি।
 
#দুই, সাধারণ হাইজিন মেনে চলি। খাবার আগে বা এবং ঘন্টায় অন্তত একবার করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি। নাকে-মুখে হাত যথাসম্ভব কম দিই।
 
#তিন, “আমি একা কি করব? সবাই তো মানছে না” – এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনার মাধ্যমে যদি একজনও ক্ষতিগ্রস্থ হয় সে হল আপনার প্রিয়জন। বাবা-মা-স্বামী-স্ত্রী-সন্তান। যার সঙ্গে আপনি দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছেন তাকে আপনিই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো? বয়স্ক মানুষ ছাড়াও যাদের হাইপ্রেসার, সুগার, হার্টের অসুখ, কিডনি, ক্যান্সার বা অন্য কোনো সাধারণ ক্রনিক রোগ আছে, করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলে তাঁদেরও মৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। 
 
তিনটে বিষয়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বাইরে না বেরোনো। কতদিন না বেরিয়ে সম্ভব? ঠিক দু-সপ্তাহ। আপনি হয়ত স্ট্রং, সাধারণ ফ্লুয়ের উপসর্গও নেই। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও আপনি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু চোদ্দদিনের মধ্যে আপনি যদি কোন অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসেন তাহলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এটা ভেবে শিক্ষিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যদি এটুকু মেনে চলে তাহলেই আমরা নিরাপদ থাকব।
 
আসুন দেখিয়ে দিই, প্রথম বিশ্বও যেটা পারেনি, আমাদের গরিব দেশ সেটা করে দেখিয়েছে।

Related Posts

Leave a Reply