১৮ হাজার মৃত্যু তাড়া করা ১০ বছর
আজ থেকে দশ বছর আগে মার্চের এক শুক্রবার সকালে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিলো জাপানের পূর্ব উপকূলে যাতে তছনছ হয়ে যায় ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। নয় মাত্রার ওই ভয়াবহ ভূমিকম্পের জেরে সুনামির সৃষ্টি হয়। এতে পুরোপুরি ভেসে যায় হংসু দ্বীপ আর আঠার হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
বড় ধরণের ঢেউ আঘাত হানে ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এবং এর পারমানবিক চুল্লি প্লাবিত হয়ে পড়ে জলে, যা বড় ধরণের বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটায়। কর্তৃপক্ষ একটি এক্সক্লুসিভ জোন তৈরি করে যা দিন দিন বড় হতে থাকে, কারণ ওই কেন্দ্রটি থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছিল। ফলে আশেপাশের এলাকা থেকে দ্রুত প্রায় দেড় লাখ মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়।
ওই ঘটনার এক দশক পরেও ওই এক্সক্লুসিভ জোনটি যেমন ছিলো তেমনই আছে এবং সেখানকার বেশিরভাগ অধিবাসী আর ঘরে ফিরে আসতে পারেনি। কতৃপক্ষের ধারণা ৪০ বছর লাগবে কাজ শেষ করতে। আর এতে খরচ হয়েছে জাপানের ট্রিলিয়ন ইয়েন।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কোথায় ছিল
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জাপানের ফুকুশিমার ওকুমা শহরে যা দেশটির পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় টোকিও থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে অবস্থিত। ২০১১ সালের ১১ ই মার্চ স্থানীয় সময় বেলা পৌনে তিনটায় ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। মূল জায়গাটি ছিলো ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মাত্র ৯৭ কিলোমিটার দুরে সেন্দাই শহরে। কিন্তু প্রায় ১৪ মিটার বা ৪৬ ফুট উঁচু ঢেউ ফুকুশিমায় আঘাত হানার পর পুরো কেন্দ্র পানিতে সয়লাব হয়ে যায় এবং জরুরি জেনারেটরগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে।কর্মীরা বিদ্যুৎ পুনরায় চালুর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু এর মধ্যেই রিয়েক্টরের মধ্যে পারমানবিক ফুয়েল প্রচণ্ড গরম হয়ে যায় এবং কোরের একটি অংশ গলে পড়ে।এরপর ওই কেন্দ্রে কয়েকটি রাসায়নিক বিস্ফোরণ হয় যাতে পুরো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রেডিও এক্টিভ উপকরণগুলো লিক হয়ে বেরিয়ে এসে পরিবেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এ কারণেই দ্রুত লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয় এবং এক্সক্লুসিভ জোন তৈরি করা হয়। সুনামি ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনার কারণে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিপর্যয়ে তাৎক্ষনিকভাবে কেউ মারা যায়নি তবে বিস্ফোরণে কেন্দ্রটির ১৬জন কর্মী আহতে হয়েছিলো।আর রিয়েক্টর নিয়ে যারা কাজ করছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে রেডিয়েশনে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে কয়েকজনকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ বিপর্যয়ের ক্ষতি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৩ সালে যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে বলা হয় ওই বিপর্যয় অঞ্চলটিতে ক্যান্সারের হার বাড়ায়নি।
২০১৮ সালে জাপান সরকার ঘোষণা দেয় যে রেডিয়েশনের কারণে একজন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। তবে স্থানীয় হাসপাতাল ও বাড়িঘর থেকে লোকজনকে জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নেয়ার সময় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি ওই দুর্ঘটনাকে সাত মাত্রার দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে যা এ ধরণের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। রাশিয়ার চেরনোবিল এর দ্বিতীয় উদাহরণ।
জাপানের ভেতর ও বাইরের বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস রেডিয়েশনের ঝুঁকি ছিলো তুলনামূলক কম। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন এর বিপদ ছিলো অনেক বেশি। বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার পরও বেশিরভাগ অধিবাসীই আর সেখানকার বাড়িঘরে ফিরে যাননি।
জাপান পার্লামেন্টের একটি স্বাধীন তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় যে ‘এটি মনুষ্য সৃষ্ট’ দুর্ঘটনা এবং এনার্জি কোম্পানিকে দায়ী করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করার জন্য। দশ বছর পরেও এখন জাপানের উত্তর পূর্বাঞ্চলের অনেকগুলো শহর বন্ধ আছে এবং কর্তৃপক্ষ পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে যাতে অধিবাসীরা ফিরে আসতে পারেন।