গরুমারার গরু বনাম ঘোড়ামারার ঘোড়া (গল্প)
অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়:
আমার বাবা,বিধান চন্দ্র ঘোষাল ছিলেন গরুমারা ফরেস্টের কেরানী।কাকা নিদান চন্দ্র ঘোষাল ছিলেন ঘোড়ামারা হাই স্কুলের পি’টি টিচার,খেলার মাস্টার মশাই। বাবা কাকা দুই জমজ ভাই।দশমিনিটের ছোট বড়!সেইমত দু জনের একই বছরের একই মাসে চাকরিতে অবসর নেবার কথা।
আমার ঠাকুরমা তখনো বেঁচে। দু-জায়গা থেকে তাঁর কাছে দু-ছেলের দু-দুটো চিঠি এল। বড় লিখল, ‘মা এই গরুর চাকরি শেষ হল,আমি বাড়ি ফিরছি’। ঘোড়ামারার ছেলে চিঠি দিল-‘ঘোড়ার চাজকরির অবসান হয়েছে মা, বাড়ি ফিরছি’।
যথাসময়ে লটবহর নিয়ে দুভাই তাদের পোলবার গণ্ডগ্রামের বাড়ি ফিরলেন।যেন ভুবন জয়ী দুই বীর। বাবা কাকাকে দেখে আনন্দে বাড়ির লোক নাচবে কি, তাদের সাথের দুই প্রাণী দেখে সকলে চোখ কপালে তুলল। ঠাকুরমাাতো আর্তনাদ করে উঠলেন!গরুমারার ছেলের সাথে এসেছে একটা গরু। ঘোড়ামারার ছেলে সাথে এনেছে একটা ঘোড়া।উঠোনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাদা রঙের গরু আর কালো রঙের ঘোড়া দুটিতে চোখবুজে জাবর কাটছে।যেন চারপাশের হট্টগোলের মজা নিচ্ছে।ওদিকে বারান্দায় বাবা আর কাকা দুজনে সমানে তিড়িংবিড়ং লাফাচ্ছেন। তাই দেখে মা কাকী ঠাকুমা আমরা দুভাই চোখ কপালে তুলে স্তব্ধবাক।
বাবার এককথা। ‘ঘরে নাতি নাতনি আসবে, মা’র বয়েস হচ্ছে,আমরা বুড়ো হচ্ছি এখন সবার একটু খাঁটি দুধ খাওয়া দরকার। এই গরু থাকলে সে ভাবনা থাকবে না মোটে,-এতো সোজা ব্যাপার। আমিও একটা কাজ পাবো। এই গরুর দেখভাল আমিই করবো, ব্যাস’। ‘আহাহা কি কথা!, বাড়িতে দুধ লাগবে,কাজেই গরু পুষতে হবে। কেন গ্রামের গয়লারা কি সব মরেছে? তারা দিতে পারবে না খাটী দুধ?ঘোষাল বাড়ির ওপর তাদের সব কৃতজ্ঞতা কি উবেগেছে? কিন্তু বাজার হাট করতে, পঞ্চায়েত যেতে,মা’র গঙ্গাস্নানে, ঘোড়া একটা থাকলে কত্ত সুবিধা! পেট্রোল লাগেনা,রিপেয়ারিং খরচ লাগেনা,লাইসেন্স ইনসুরেন্স লাগে না, কাদায় চাকা বসে যাওয়া নেই কত্ত সুবিধা বলত?আর এর দেখভালতো আমিই করব, আমিতো বলেছি’ কাউকে কিছু করতে হবে না। সব দায়িত্ব আমার’।
বাবা কাকা দুজনেই দুজনকে সমানে তড়পে চলেছেন।আর আমরা সব নিরব দর্শক মাত্র। সবার গলা ছাপিয়ে হঠাৎই ঠাকুমা ধমকে উঠলেন। ‘বলি হচ্ছেটা কি বিধু নিধু?বাড়িটা কি চিড়িয়াখানা? তোরা দুটোয় গরু ঘোড়া নিয়ে হাজির হলি, এরপর আমার দু’নাতি যদি ছাগল গাধা নিয়ে হাজির হয় তখন? ওসব পাগলামি ছাড় বাবারা।আমার খাটি দুধেরও দরকার নেই আর ঘোড়ায় চেপে গঙ্গা স্নানেরও দরকার নেই’। আমার বউ বিনি হৈচৈ শুনে রান্নাঘর ছেড়ে হলুদমাখা হাত আঁচলে মুছতে মুছতে অকুস্থলে হাজির হয়ে এক কাণ্ড করে বসল। বলা নেই কওয়া নেই বারান্দায় রাখা জলের বাল্টি থেকে দুঘটি জল নিয়ে দিলে গরু ঘোড়ার চার চার আট খুড়ে জল ঢেলে। তারপর ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়লে- ‘ও ঠাম্মা এমন করছ কেন বলত? বাবা কাকা শখ করে দু-টো গরু ঘোড়া নয় এনেছে, ক্ষতিতো কিছু নেই।
‘নাত বউর কথায় ঠাকুমাও যেন কাতর হলেন। বাবা কাকা তাদের বউমার বিবেচনায় মুগ্ধ হয়ে বিবাদ ভুলে পরস্পর কে জড়িয়ে ধরে ‘ভাই রে’, ‘দাদা গো’ বলে চোখের জল ফেলা শুরু করে দিলেন। মা কাকীমা কলকল করে হুলুধ্বনি দিয়ে উঠলেন। গরু ঘোড়া বাড়িতে বহাল হল।
গরু ঘোড়াতো বহাল হল, বাড়ির লোকজনের হালও বেহাল হওয়া শুরু হল।বাবা গরুর জন্য গোয়াল ঘর বানাতে বাঁশ বেড়া টালি দিয়ে লোক লাগানতো,কাকা ইট কাঠ টিন দিয়ে ঘোড়ার আস্তাবল বানাবার লোক জোগাড় করে আনেন।গরুর খাবার খড়, খোল ভূষি মাটির চাঙাড়ি আসে। ঘোড়ার খাবার চানা দানা কচিঘাসে ঘর বোঝাই হয়ে ওঠে।উঠোন বারান্দা রান্নাঘর মায় বসার ঘর অবধি একে একে দখল হতে থকে গরু ঘোড়ার প্রয়োজনীয় জিনিসে। বাবা গরুর জন্য এক বস্তা ভেলি গুড় নিয়ে এলেন কি, কাকা নিয়ে এলেন এক টিন আখের গুড় তার ঘোড়া খাবে বলে।বাবা গরুর জন্য রকমারি ঘণ্টা পুঁতির মালাও আনতে পারেন, কাকা নিয়ে এলেন তার ঘোড়ার জন্য মাথার রঙিন পালকের উষ্ণীশ,চামড়ার মুখবন্ধ, লাগাম।দুই রিটায়ার্ড বুড়োর খোকাপনায় গোটা বাড়ি অস্থির।বাবা মাকে ডাকেন ‘কি হল ফ্যানটা দাও’,তো কাকা কাকীমাকে হেদিয়ে মরেন ‘বলি হচ্ছেটা কি?দু কেজি কড়াইশুটি ছুলতে কতক্ষণ লাগে বল দেখি’?
ঠাকুরমা তার দুই ছেলের পশুপ্রেমের বহরে হাঁপিয়ে ওঠেন।মা কাকীর মুখ ভার। আমরা মুখ টিপে হাসি। পাড়ার লোক অবধি উঁকি ঝুঁকি মেরে মুখ চাওয়া চায়ি করে। গোটা পাড়া ভেঙ্গে দুআধখানা হয়ে যায়। একদল গোপক্ষে।আর একদল ঘোপক্ষে!সমবেত দাবী ওঠে অবলা প্রাণীদুটির নামকরণের।
যেদিন বিকেলে আমার কাকার মেয়ে,আমাদের একমাত্র বোন রাখী,বাড়িতে গরু-ঘোড়া আগমনের খবর পেয়ে ছেলে জামাই নিয়ে সরেজমিনে হাজির হল, সেদিনই রাতের খাবার পাট মিটলে কাকা ই ঠাকুরমা কাছে বায়না ধরলেন-‘মা, এ তোমার সংসার, তোমার ঘর বাড়ি,তোমার ঘোড়া তোমারই সব। তুমিই তোমার ঘোড়ার একটা বেশ জম্পেশ নাম দাও দেখি’।
বাবা শুনেই লাফিয়ে রে রে করে মাঠে নামলেন।‘মা, এ তোমার গরু, তুমি এর একটা নামকরণ কর দেখি ঝটাপ্পট।‘ঠাকুরমা সবাইকে গোল করে বসিয়ে প্রস্তাব দিলেন গাই গরুর নাম হবে কপিলা,আর মদ্দা ঘোড়ার নাম হবে চৈতক।যদিও আমরা গরু ঘোড়ার নাম নিয়ে মোটেই ভাবিত ছিলাম না,বরং দুশ্চিন্তায় ছিলাম দুই বুড়োর কীর্তি কলাপে।তবু নামকরণ নিয়ে একেবারে মৌলিক প্রশ্ন তুললে আমার একমাত্র ভাগ্নে, ক্লাস ফাইভের ছাত্র,রাখীর ছেলে-শ্রীমান প্রাংশু।‘আচ্ছা ঠামু, বদ্দাদু কি বশিষ্ঠ মুনি যে তার গরুর নাম হবে কপিলা? না ছোদ্দাদু রাণাপ্রতাপ? যে তার ঘোড়ার নাম হবে চৈতক’?
নাতি প্রাংশুর পুরাণ ইতিহাস জ্ঞানে তার দুই দাদু যখন মুগ্ধ, আমরা মুখটিপে হাসাহাসি শুরু করেছি আরকি, রাখী ধমকে ওঠে তার ছেলেকে।‘এই চুপ, পাকা পাকা কথা বলিস না তো তুই’।ঠাকুমা নাতনী রাখীকে থামিয়ে দিয়ে বলেন-‘কেন রে, দাদাতো ঠিকই বলেছে গরু ঘোড়া পুরাণ ইতিহাস নিয়ে এখন যা পিণ্ডি চটকানো চলছে দরকার কি ঝামেলায় যেয়ে’?
ঠাকুমা তার পুতিকেই নামকরণের ভার দিলে শ্রীমান প্রাংশু গরুটি সাদা বলে নাম দিলে ধলা আর কালো ঘোড়ার নাম দিল কালা।সভায় সর্বসম্মতিতে সে নাম গৃহিতও হল। কালো কে কালো বলে ডাকায় কাকীমা একটু খুতখুতি দেখালে, ঠাকুমা দিলেন এক ধমক তার বৌমাকে। কাকী চুপ। দুই বুড়ো ও কালা ধলায় বাড়ি যখন জমজমাট তখনি এক কাণ্ড ঘটলো।
ঘোড়াটার ডানা গজালো,পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়ে ভর দুপুরে সবার চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেল!আর তার দেখাদেখি ধলা গরুটা,হঠাৎই আকাশের দিকে মুখ করে হাম্বা ডেকে গলার দড়িটা পটাং করে সুতোর মত ছিঁড়ে লেজ তুলে দিলে ভোঁ দৌড়।পেছন দিকে ফিরেই তাকালে না।
কাকা মুখ বেঁকিয়ে খালি বললেন “দাদার ট্যাশ্ গরু ভাগল্ বা”বাবা গোঁ গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন!