তিনিই বিশ্বকে শ্যাম্পুর ব্যবহার শিখেয়েছেন
কলকাতা টাইমস :
ইংরেজিতে বই প্রকাশ করা প্রথম ভারতীয় বাঙালি পর্যটক শেখ দীন মোহাম্মদ। বিলাসী শ্যাম্পু ও সাবান দিয়ে ইংরেজদের স্নান করাও শেখান এই দীন মোহাম্মদ।
এছাড়া ব্রিটেনে প্রথম ভারতীয় রেস্তোরাঁর যাত্রাও শুরু হয় তারই হাত ধরে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা : দীন মোহাম্মদের জন্ম ১৭৫৯ সালে ভারতের পাটনায়। সে সময় পাটনা বাংলার অধীনে ছিল। এখানেই তিনি বেড়ে উঠতে থাকেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান।
ছাত্রাবস্থায় তিনি আলকেমি সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা করে ক্ষার ও ক্ষারক এবং সাবান নিয়ে বিস্তর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এরপর তাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানবিশ সার্জন হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৭৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাপ্টেন বেকারের তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং চাকরি থেকে অবসর নেয়া বেকারের সঙ্গে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান।
ভ্রমণ নিয়ে বই : ১৭৯৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বইটি প্রকাশ করেছিলেন শেখ দীন মোহাম্মদ। ‘দ্য ট্রাভেলস অব দীন মোহাম্মদ’ নামের বইটি ছিল তার আত্মজীবনী।
বইটিতে সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় নিজস্ব নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় শহর ও সামরিক বিষয়াদির বর্ণনা দেন। বইটি চেঙ্গিস খান, তৈমুর লঙ এবং বিশেষ করে প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের প্রশংসা দিয়ে শুরু হয়।
এছাড়া ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং স্থানীয় ভারতীয় শাসকদের সঙ্গে সামরিক সংঘাতের একটি সিরিজ বর্ণনা করা হয়। তার এ বইয়ে ঢাকার বিবরণও আছে। ১৭৮৩ সালে ঢাকা ঘুরে যাওয়ার কথা বিস্তারিত লিখেছেন তিনি এ বইয়ে।
রেস্তোরাঁ ব্যবসায় : ১৮১০ সালে ইংল্যান্ডে কফি হাউস দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন শেখ দীন মোহাম্মদ। এরপর রেস্তোরাঁ খোলেন তিনি। তিনিই প্রথম ভারতীয় তথা দক্ষিণ এশীয়, যিনি পশ্চিমা দেশে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণার ব্যাপক প্রচলন করেছিলেন।
ইংরেজদের গোসল শেখানো : ইংরেজরা ‘শ্যাম্পু’র পুরো কৃতিত্ব নিলেও এ প্রসাধনীর উদ্ভাবক শেখ দীন মোহাম্মদ। তার কাছেই ব্রিটেনের মানুষ প্রথমে জানতে পারে, চুলের পরিচর্যা কিভাবে করতে হয়। পয়সা খরচ করে সে সময় দীন মোহাম্মদের কাছে অভিজাত ইংরেজরা আসতেন ‘শ্যাম্পু’ করতে।
লন্ডনে নতুন চাকরি : ১৮০৭ সালে তিনি অনারেবল বেসিল কোশরেন নামে এক স্কটিশ অভিজাতের কাছে চাকরি নেন। কোশরেন এক সময় ভারতবর্ষে অবস্থানকালে প্রচুর ধনসম্পদ অর্জন করেছিলেন।
পরে তিনি লন্ডনে একটি উষ্ণ বাষ্প থেরাপি চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেন। গবেষক মাইকেল ফিশার লিখেছেন, ‘দীন মোহাম্মদ কোশরেনের চিকিৎসাকেন্দ্রে ভেষজ মালিশ চিকিৎসা প্রচলন করেন।
দীন মোহাম্মদই ‘শ্যাম্পুয়িং’ নামে এ মালিশ চিকিৎসা ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় করে তোলেন।’ ‘শ্যাম্পু’ শব্দটি মূলত হিন্দি ‘চাম্পো’ (চাপ দেয়া) শব্দ থেকে এসেছে। পরবর্তী সময়ে এ মালিশচিকিৎসা খ্যাতি লাভ করে।
ঢাকা সফর : বেকার ও দীন মোহাম্মদ কিছুকাল পূর্ববাংলা সফর করেন। তারা ঢাকা শহরেও এসেছিলেন। তখন ঢাকা মসলিন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। ঢাকায় তখন নওয়াব কর্তৃক প্রতি বছর যে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও গণউৎসবের আয়োজন হতো, তিনি সেই উৎসব প্রত্যক্ষ করেন। তারপর বাঘ ও ডাকাত পরিবেষ্টিত গভীর জঙ্গল সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌকাযোগে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছান।
আয়ারল্যান্ডে অভিবাসন : ১৭৮৪ শেখ দীন মোহাম্মদ বেকার পরিবারের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের কর্কে স্থানান্তরিত হন। সেখানে একটি স্কুলে ভর্তি হলেন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য। এ স্কুলে পড়াকালেই ভালোবাসায় পড়ে যান স্কটিশ সুন্দরী জেন ডেলির। ডেলি পরিবারের প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও তারা অন্য শহরে গিয়ে বিয়ে করেন ১৭৮৬ সালে। সেখান থেকে উনিশ শতকের শুরুতে তারা ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে পাড়ি জমান। সেখানে তাদের পরিবারে আসে সাত সন্তান।
তিনি চলে গেলেন : ১৮৫১ সালে ৯২ বছর বয়সে তিনি মারা যান ব্রাইটনের গ্র্যান্ড প্যারেডে। সেন্ট নিকোলাস চার্চে তাকে সমাহিত করা হয়।