November 21, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular শিল্প ও সাহিত্য

বোমা নয় তুবড়ি হতে চেয়েছিল

[kodex_post_like_buttons]

সৌগত রায় বর্মন 

মা কালির সঙ্গে ভূত প্রেতের যে কী সম্পর্ক তা জানা নেই, আর জানা নেই বলেই ভূত তাড়াতে আমরা বাজি ফাটাই। একটা বাজির নামই হয়ে গেল কালি পটকা। তুবড়ি, হাওয়াই, রকেট ইত্যাদি বাজি আলোর আর পটকা, দোদমা, চকলেট বোমা, ঘটি বোমা, কলসি বোমা – শব্দের। বাজি ফাটানোর মূল উদ্দেশ্যই মনে হয় ভূত পেত্নির উৎপাত দূর করা।

কালি পুজো মানেই ঘোর আমাবশ্যা। এটাই তো ভূত তাড়ানোর আদর্শ সময়। ভূত বিশ্বাসীদের মতে ঘোর অন্ধকারেই ভূত প্রেতলোক থেকে ইহলোকে আসে। আসার সঙ্গে-সঙ্গে তাদের বিদায় করার কী দরকার আছে, জানা নেই।
বাবা শিব ভূত প্রেত নিয়েই থাকেন। ছাই-ভস্ম মাখেন। পিশাচদের সঙ্গে থাকতেই ভালোবাসেন। তাই যদি হয় তাহলে বাবার বন্ধুদের ভয়ের কী আছে। সম্পর্ক আছে বই কি আমাদের সঙ্গে। ভূতকূল আমাদের জ্যাঠা কাকাদের দলে পড়েন
 যাই হোক মূল গল্পে আসি। আমাদের ছোটবেলায় তুবড়ি কাকা খুব নামডাক করেছিলেন বাজি বানিয়ে। দূর দূর গাঁ থেকে কাকার আগাম বায়না হয়ে যেত, এক বছর আগে থেকেই। বিশ্বকর্মা পুজো শেয হতে না হতেই কাকার বাড়িতে বাজির মশলা আসতে শুরু করত। তখনকার সময় ঠেলাগাড়িতে কাঠকয়লা, সোডা, গন্ধক, আরও কত কী যে আসত তার বেশ কিছুর নামই আমরা জানতাম বা। জিজ্ঞেশ করলে তিনি রহস্য করে বলতেন, শিব ঠাকুরের আপন ঘর থেকে এসেছে, নাম বলা বারন আছে রে! কাকার দুই সাগরেদ কালিকাকা ও ধানিকাকাও হাত লাগাতেন। দাড়িপাল্লায় কি সব মাপ-জোঁক কযে তারপর ভাগে-ভাগে মেশানো হত। একদিকে তুবড়ি- কোনোটা বসন, কোনোটা উড়ন্, কোনওটা ঘটি, কোনোটা বা কলসি। পটকার মশলা বানিয়ে কাকা নিজের জাত খোয়াতেন না। ওসব তো চোর ডাকাতরা বানায়। ভদ্রলোকরা বানাবে তুবড়ি। একদিন এমন দিন আসবে দেখবি ওই তুবড়ি চড়েই মানুয চাঁদে যাবে। আমরা বিস্মিত হয়ে কাকার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলতেন, তোদের রকেট, স্পুটনিক আর আমার তুবড়ি তো একই রে! নাসার একটা বিজ্ঞানিকে হাতের কাছে পেলে অঙ্ক কসে দেখিয়ে দিতাম কত কম খরচে তুবড়ি চড়ে চাঁদে ফেরিঘাট চালানো যায়। আমরাও সপ্ন দেখতাম একদিন কাকার তুবড়ি চড়ে চাঁদে পুজোর ছুটি কাটিয়ে আসব। কাকাকে হাতে পায়ে ধরে মিনতি করতাম, আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যেও। বাদ দিও না প্লিজ।
সাতের দশকের মাঝামাঝির সময়। আমরা তখন একটু বড় হয়ে গেছি। শুনলাম কাকা নাকি তুবড়ি বানানো ছেড়ে দিয়েছে। কেউ তেমন পয়সা দেয় না বলে, ইদানিং বোমা বানাচ্ছে। লাল-সাদার। বিভিন্ন দল পয়সা দিয়ে কাকার বোমা নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে কাকার সঙ্গে না মিশতে। ভয় পেতে শুরু করলাম আমরা। শুধু আমরাই নই। গ্রামের কেউই কাকার সঙ্গে কথা বলত না। কাকা ক্রমশ একঘরে হয়ে গিয়ে গ্রামের শেয প্রান্তে একটা পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। এক সময়ে নাকি এখানকার রাজবাড়ি ছিল। এখন ভূতের বাড়ি বলে লোকে। সেটাই কাকার বাস এবং কারখানা।
এক মধ্যরাতে এমনই এক কালিপুজোর রাতে, যখন শব্দ ব্রহ্ম হয়ে আছে। একটানা আওয়াজে ঝিম মেরে আছি আমরা, ঠিক তখুনি এক প্রবল আওয়াজ। ভেসে এলো গ্রামের শেয প্রান্ত থেকে যে দিকে কাকার ভূতের বাড়ি। অনেকক্ষন ধরে শব্দের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি ফিকে হয়ে এলে আমরা বাড়ির মানা ত্যাগ করে ছুট দিলাম সেই বাড়ির দিকে, যেখানে কাকার কারখানা বা বাড়ি। কোথায় কী? বাড়ি বলে কিচ্ছু নেই, শুধু পোড়া মাঠ, ছাই আর ধিকি ধিকি আগুন। কাকাও নেই। চলে গেছেন চাঁদের দেশে। কথা রাখেননি কাকা। কথা ছিল একসঙ্গে যাবো। বোমা নয় তুবড়ি চেপে। কাকা কেন বোমা বানাতে গেল? বোকার মতো?
তারপর থেকে মাঝে মাঝেই, কালিপুজোর রাতে সেই শব্দ পাই। সমস্ত আওয়াজ ছাপিয়ে একটা গগনভেদী আওয়াজ। কেউ যেন চিৎকার করে বলছে, বোমা নয় বোমা নয়, আমি তুবড়ি হতে চেয়েছিলাম।
কাকা ভূত না ভবিষ্যৎ তা বুঝতে পারি নি আজও। 

Related Posts

Leave a Reply