যদি মিষ্টি খেতে চাও তবে মালাইকারি মিষ্টি খাও, রহস্যটাও জেনে নাও
মিষ্টির নাম মালাইকারি। মিষ্টি ভোজন রসিকদের কাছে পছন্দের তালিকার অন্যতম নাম। শুধু নামে নয় এর রস, গন্ধ, বর্ণ, স্বাদ সবই অতুলনীয়। এটা দেখতে যেমন লোভনীয় তেমনি খেতেও। রসে ভরা। যে একবার এর স্বাদ নিয়েছে সে বার বার খেতে চাইবে। অনেকে বলে থাকে- যদি মিষ্টি খেতে চাও তবে মালাইকারি মিষ্টি খাও।
শুধু কথায় নয়, আসলেই এর স্বাদই একে অনন্য করে তুলেছে। স্বাদের মত প্রস্তুত প্রণালীটাও একটু ভিন্ন। মালাইকারির মূল উপকরণ দেশি গরুর খাটিঁ দুধ আর চিনি। প্রথমে তৈরি করা হয় দুধের ক্ষীর আর ছানা। কারখানায় ময়রারা (মিষ্টি তৈরির কারিগর) বিশেষ কৌশলে এই মিষ্টি তৈরি করে থাকে। দুধ ও অন্যান্য উপকরণ জ্বাল দিতে হয় কাঠের চুলায়। তারপর ছানায় তৈরি এই মিষ্টি দীর্ঘ সময় ভাঁজা হয়। যার ফলে এর বাহিরের অংশে একটা আবরণ সৃষ্টি হয়। ভাঁজার পর একে তুলনামূলক কম ঘন সিরায় ডুবানো হয়। সিরা থেকে তুলে একেকটি বড় সাইজের মিষ্টি মাঝামাঝি কেঁটে এতে অত্যন্ত ঘন মালাই বা ক্ষীর এর প্রলেপ দেওয়া হয়। এই মালাইয়ের স্বাদ অক্ষুন্ন রাখার জন্যই এই মিষ্টির সিরা হালকা রাখা হয়। যার ফলে মালাইকারি বেশ নরম ও বিশেষ সুঘ্রাণ বিদ্যমান থাকে। এর বিশেষ নরম অবয়র ও সুঘ্রানই এই মালাইকারিকে স্বাদে অন্যন্য ও বিখ্যাত করে তুলেছে।
আমাদের দেশে মালাইকারির নাম মুখে আনলে প্রথমেই চলে আসে আদি ময়মনসিংহের সুধির ঘোষ মিষ্টান্নের মালাইকারির কথা। পরবর্তীতেই আসে একই জেলার কৃষ্ণা কেবিনের নামটি। এদের পর পর আসে ফরিদপুর, পাবনা, ঢাকার আলাউদ্দিন সুইটস মালাইকারির নাম।
সুধির চন্দ্র ঘোষ নিজেই এদেশে প্রথম মালাইকারি তৈরি করে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছরের অধিক সময় আগে। সুধির চন্দ্র ঘোষ বয়সের ভারে এখন মিষ্টি তৈরির কাজ থেকে অনেকটা অবসর নিয়েছেন। সুধির চন্দ্র ঘোষের দুই ছেলে সুবোধ চন্দ্র ঘোষ এবং শংকর চন্দ্র ঘোষ মিলে চালিয়ে যাচ্ছে মালাইকারির এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাটি। বর্তমানে ময়মনসিংহের স্বদেশী বাজারে একটি শাখা রয়েছে। এর কেজি প্রতি দাম রাখা হয় ১৮০-২০০ টাকা। মূলত সুধির ঘোষের বদৌলতে মিষ্টি ভোজন রশিকরা এই অপূর্ব সৃষ্টি মালাইকারির স্বাদ গ্রহণ করতে পারছে কয়েক দশক ধরে।
অন্যদিকে কৃষ্ণা কেবিন শহরের স্টেশন রোডের একটি শাখার মাধ্যমে রনজিৎ বসাক এর মালিকানায় এই মালাইকারি তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। যার কেজি প্রতি দাম ২০০ টাকা। যাদের নাম, যশ ও খ্যাতি এখন বেশ। বর্তমানে এদের অনুসরণ করে ময়মনসিংহ শহরে আরো বেশ কিছু মিষ্টির দোকানীরা মালাইকারি তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। তবে ময়মনসিংহ তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে মালাইকারি বলতে সুধির ঘোষের মালাইকারির নামই সবার আগে চলে আসে।
ময়মনসিংহ ছাড়া ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার বাগাটে তৈরী হয় স্পঞ্জ জাতীয় হালকা ক্ষীর যুক্ত মিষ্টি মালাইকারি। বাগাটের তৈরি এই মালাইকারি মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি করে ফরিদপুর শহরের হোটেল র্যাফেলস ইনের মোড়ে অবস্থিত বাগাট রাজকুমার মিষ্টান্ন ভান্ডার। বাগাট রাজকুমার মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক সুকুমার ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায় এর বেশ কিছু তথ্য। ২০০২ বা ২০০৩ দিকে তিনি কলকাতার ভিআইপি রোডের হলদিরাম সুইট থেকে নিয়ে আসেন এই মালাইকারির কিছু সেম্পল। পরবর্তীতে তিনি সেই সেম্পল পরখ করে এবং কারখানার দক্ষ কারিগর দ্বারা তৈরি করেন আজকের বাগাটের এই মালাইকারি। তারা বর্তমানে মালাইকারি এবং রোস্ট মালাইকারি নামে দুটি আইটেম তৈরি করে থাকে। যার দাম কেজি প্রতি যথাক্রমে ৪০০ টাকা এবং ৪২০ টাকা। তিনি জানান তাদের মিষ্টির ব্যবসা বংশ পরস্পরায়। তাই বলা চলে কলকাতা থেকে বয়ে নিয়ে আসা মালাইকারি বেশ সুনামের সাথেই গ্রহণ করেছে এদেশের মিষ্টি ভোজন রশিকরা।
অন্যদিকে জানা যায়, পাবনা জেলায়ও তৈরি করা হয় সুস্বাদু, জিভে জল আসা ও মুখরোচক এক জাতীয় মালাইকারি মিষ্টি। পাবনা জেলায় প্যারাডাইস সুইটস নামে একটি মিষ্টি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এই মালাইকারি তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। কথা হয় প্যারাডাইস সুইটস এর মালিক নূরুল আমিন সোহেলের সাথে। তিনি জানান, আজ থেকে প্রায় ষোল বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে শম্ভু ঘোষ নামে এক মিষ্টির কারিগর আনা হয় তাদের কারখানায়। তিনিই প্রথম পাবনায় মালাইকারি তৈরি করেন। পরবর্তীতে কুরবান নামে এক শির্ষকে মালাইকারি তৈরির কারিগর বানান। বর্তমানে প্যারাডাইস সুইটস এর ঢাকায় তিনটি শাখা এবং পাবনায় আরও একটি শাখা রয়েছে। মূলত পাবনার কারখানা থেকেই ঢাকার তিন শাখায় এই মিষ্টি মালাইকারি সরবারহ করা হয়। প্যারাডাইস সুইটস এর মালাইকারির কেজি প্রতি দাম রাখা হয় ৩৮০ টাকা।
ঢাকার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান আলাউদ্দিন সুইটমিট। ১৮৯৪ সালে ঢাকার চক বাজারে প্রথম মিষ্টির দোকান প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার আদি বাসিন্দা আলাউদ্দিন। পরবর্তীতে তার ছেলে ও বর্তমানে তার নাতীরা এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। এখন তাদের দেশ বিদেশে মোট ১৬টি শাখা রয়েছে। ১২২ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটিও বেশ সুনামের সাথে মালাইকারি তৈরি ও বিক্রি করে থাকে।
ঢাকার বনশ্রী আবাসিক এলাকায় পুষ্টি ডেইরি ফার্ম সুইটস এন্ড বেকারি নামে একটি প্রতিষ্ঠানও বেশ কয়েক বছর ধরে মালাইকারি তৈরি ও বিক্রি করছে।
আসলো কোথা থেকে
প্যারাডাইস সুইটস এর মালিক নূরুল আমিন সোহেলের মতে এর আদি বাস পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায়। এর পেছনে তার যুক্তিটা হলো তার কারখানায় প্রথমে কলকাতা থেকেই মালাইকারি তৈরির কারিগর আনা হয়। কলকাতা থেকে আসা ময়রা শম্ভু ঘোষ থেকে তিনি জানতে পারেন যে মূলত কলকাতার অভিজাত বেশ কিছু এলাকায় এই মালাইকারি তৈরি করা হতো। শম্ভু ঘোষও সেখানেই কোন এক কারখানায় শিখে ছিল মালাইকারি তৈরির কাজটি। অন্যদিকে বাগাট রাজকুমার মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক সুকুমার ঘোষ তো কলকাতা থেকেই নিয়ে এসেছে নিজেই। তাদের দু জনের মতে প্যান্টেট, ট্রেডমার্ক বা আদিবাস যেখানেই থাকুক বর্তমানে মালাইকারি আমাদের তৈরি অন্যন্য স্বাদের মিষ্টি। যা আমরাই টিকিয়ে রাখব এর ঐতিহ্য।