রাজীবলোচন থেকে হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংসকারী কালাপাহাড়
কলকাতা টাইমস :
প্রাচীন হিন্দু মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হলেই একটি নাম অবধারিত ভাবে উঠে আসে‚ তা হল কালাপাহাড়| বাস্তবিকই তার হাতে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য হিন্দু দেবালয়| বাংলা ও ওড়িশার বহু মন্দির‚ বিগ্রহ ধ্বংস করেছিলেন তিনি|
কিন্তু জানেন কি তিনি ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ হিন্দু ব্রাহ্মণ? আসুন‚ চোখ রাখি তার জীবনে| কীভাবে নায়ক থেকে হয়ে উঠলেন খলনায়ক|
মুঘলদের বহু আগেই দিল্লিতে সুলতান বংশ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মুসলিম শাসকদের হাতে| তারা মূলত তুর্কী এবং আফগান মুসলিম শাসক| মামেলুক তুর্কী বংশ যখন দিল্লিতে‚ তখনই বাংলায় সুবেদারি ব্যবস্থা শুরু হয়ে যায়| অর্থাৎ দেব বংশের শাসনের পরেই বাংলার ক্ষমতায় ইসলামিক শাসকরা|
সেই ধারায় ১৫৬৪-১৫৭৬ ক্ষমতায় ছিলেন করানি সুলতানি বংশ| ত্রিবেণীর যুদ্ধে পরাজিত হন সুলেইমান করানি| হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ রাজীবলোচন (বা কালাচাঁদ) রায় ভাদুড়ি তখন প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন| করানি বুঝতে পারেন বাংলায় তাকে ক্ষমতাসীন হতে গেলে রাজীবলোচনের সখ্যতা চাই|
রাজীবলোচনকে নিজের প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানালেন সুলেইমান করানি| বলা হয়‚ সেখানে সুলেইমানের মেয়েকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন রাজীবলোচন| যাকে বলে প্রেমে পাগল অবস্থা|
এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন সুলেইমান| তার পাতা ফাঁদে ধরা দিয়েছেন প্রতিপক্ষ| সুলেইমান-কন্যার পাণিপ্রার্থী হলেন রাজীবলোচন| সুলতান সুলেইমান বললেন তিনি এই বিবাহে রাজি| তবে রাজীবলোচনকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে হবে| রাজীবলোচন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে করলেন|
তবে তার ধর্মান্তকরণের পিছনে আরও একটি গল্প প্রচলিত| সেখানে কথিত‚ কৃষ্ণকায়-লম্বা সুপুরুষ রাজীবলোচন রোজ পুজো দিতে আসতেন মন্দিরে| প্রাসাদ থেকে তাকে দেখে মুগ্ধ হন সুলেইমানের মেয়ে| সুলতানকন্যা বাবার কাছে আব্দার করেন‚ বিয়ে করলে ওই ব্রাহ্মণ তরুণকেই করবেন| নতুবা কাউকে নয়|
এবার এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন বলে ঠিক করলেন সুলতান সুলেইমান করানি| তিনি আমন্ত্রণ জানালেন রাজীবলোচন রায়কে| বললেন‚ বিয়ে করতে হবে তার কন্যাকে| নইলে প্রাসাদের জহ্লাদের এক কোপে তার মস্তক ছেদ করা হবে| প্রাণ বাঁচাতে রাজীবলোচন রাজি হলেন বিধর্মে বিবাহে|
যে কারণেই বিয়ে হোক না কেন‚ রাজীবলোচন ইসলামে ধর্মান্তরিত হল| ধর্মান্তকরণের পরে রাজীবলোচনের নতুন নাম হয় মোহাম্মদ ফারমুলি| তবে তিনি কুখ্যাত হয়ে ওঠেন কালোপাহাড় নামেই| লোকমুখে হয়ে দাঁড়াল কালা পাহাড়| চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল নামের| তাকে সেনাপতি করে দিলেন শ্বশুর সুলেইমান করানি|
কালাপাহাড়ের তখন একমাত্র লক্ষ্য হিন্দুধর্ম‚ হিন্দু ধর্মের দেবালয় ও বিগ্রহের বিনাশ সাধন| বাকি জীবনে নির্বিচারে সেটাই করে গেছেন তিনি| অবিভক্ত বাংলা অর্থাৎ বাংলা বিহার ওড়িশা জুড়ে|
ওড়িশার তৎকালীন শাসক রাজা মুকুন্দদেবকে পরাজিত করে পুরী‚ কোণার্ক‚ সম্বলপুর‚ কটকে তাণ্ডবলীলা চালান কালাপাহাড়| ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে তার আক্রমণে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোণার্কের সূর্যমন্দির| বলা হয়‚ মন্দিরের শীর্ষে ছিল ভারী চুম্বক| ভূমিতেও ছিল চুম্বক|
প্রতিটা পাথরের দুপাশে আছে লোহার পাত| এই ব্যবস্থার ফলে মন্দিরের মূল বিগ্রহ ভাসমান অবস্থায় থাকত| কে এই চুম্বক-হরণ করে‚ তা নিয়ে দ্বিমত আছে| কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন‚ কালাপাহাড় এসে লুণ্ঠন করে নিয়ে যান ওই রহস্যজনক চুম্বক|
কালাপাহাড়কে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন কুচবিহারের রাজার ছেলে শুক্লধ্বজ ওরফে চিলা রাই| কিন্তু তিনি পরাস্ত হয়ে বন্দি হন কালাপাহাড়ের হাতে| তাম্রলিপ্তের বর্গভীমা মন্দির ধ্বংস করতে এসেছিলেন কালাপাহাড়| কিন্তু মন্দির ও দেব বিগ্রহের সৌন্দর্য দেখে তিনি কোনও এক কারণে নিরস্ত হন| আক্রমণ না করে উল্টো মন্দিরের প্রশস্তি করেছিলেন|
পরাক্রমী এই ধ্বংসকারীর মৃত্যু নিয়েও গল্প প্রচলিত| বলা হয়‚ তিনি এগিয়েছিলেন ওড়িশার সম্বলপুরে সম্বলেশরীর মন্দির ধ্বংস করতে| মন্দিরের আগেই শিবির ফেলেছিলেন| সেখানে এক তরুণী গোপিনীর কাছে দইয়ের ছাঁচ কিনে পান করেন কালাপাহাড় ও তার সেনারা| তাতেই মৃত্যু হয় তাদের| পরে সেই গোপিনীকে আর পাওয়া যায়নি| বলা হয়‚ স্বয়ং সম্বলেশ্বরী এসেছিলেন ওই রূপে|
সম্বলপুরে মহনদীর তীরে এক আমবাগানের ভিতরে বহু সমাধি আছে| মনে করা হয় ওখানেই সমাহিত হয়েছিলেন কালাপাহাড়| তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে| তবে বছর বারো আগে উগ্র ধর্মান্ধদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই সমাধিও|
সুলেইমান করানি খানের পরে বাংলার শাসক হন তার পুত্র দাউদ খান| কথিত তার নামেই চালের নামকরণ হয় দাদখানি চাল| দাউদ খানেরও সেনাপতি ছিলেন কালাপাহাড়|
দাউদ খান ছিলেন বাংলার শেষ আফগান শাসক| এরপর বাংলা চলে যায় মুঘল শাসনের অধীনে| ইতিহাসের অন্য এক সূত্র বলে‚ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন দাউদ খান ও তার সেনাপতি কালাপাহাড়