November 23, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular রোজনামচা শিল্প ও সাহিত্য

সঙ্গী দিব্যজ্যোতির দিকে তাক করা রাজা সাহেবের ছ’ঘড়া রিভালবার !

[kodex_post_like_buttons]

আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (পর্ব ৫)

সৌগত রায়বর্মন: 

বাঙালি আইজির অফিস থেকে বেরিয়ে আমাদের কাজ শুরু হল বুলেটের গতিতে। পুলিশ লাইনে গিয়ে প্রথমেই খোঁজ নিলাম সুখবিন্দর সিং এর। তাকে দিয়ে প্রায় জোর করে চিঠি লেখানো হল তার চাচেরা ভাই রামসুন্দর সিং কে। সে থাকে বুন্দেলখন্ড জঙ্গল লাগোয়া কালুয়া মাফি গ্রামে। নটরিয়াস গ্রাম বলে সেই গ্রামের বেশ সুনাম আছে। থাকবে নাই বা কেন? তিরিশ কিলোমিটার ব্যাপী এই দীর্ঘ অরণ্যানী ডাকাতদের চারণভূমি। চম্বলে যেমন বেহড় তেমনই এখানে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। বিন্ধ্যপর্বত ছাড়িয়ে এই অরন্য ভাগ হয়ে গেছে দুটি রাজ্যে- উত্তপ্রদেশ আর মধ্যপ্রদেশ। রামায়ণ অনুযায়ী এই পর্বতমালাকেই চিত্রকূট নামে অভিহিত করা হয়েছে।

ইতিহাস অনুযায়ী মহারাজ খেত সিং খাঙ্গার এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তার রাজধানির নাম ছিল গড় খাঙ্গার। সেই সময় বুন্দেলখন্ডকে বলা হত ‘জুঝাউতি’ বা যোদ্ধাদের রাজ্য। বুন্দেলখন্ড অঞ্চলেই অবস্থিত ঝাঁসি এবং খাজুরাহ। অর্থাৎ এখানকার ডাকাতরা যতই খতরনাক হোক না কেন, শিল্প বা স্থাপত্যে তারা কারও থেকে কম যেত না। এখানে এক সময় হীরে ও পান্নার খনিও ছিল।

এবার ইতিহাসকে বাদ দিয়ে বুনো হাঁস প্রসঙ্গে আসা যাক ।

পুলিশ ইনফর্মার সুখবিন্দর সিং এর একটা চিঠি সম্বল করে আমরা পোড়া কাঠ হয়ে ভোপাল থেকে বুন্দেলখন্ড পৌছলাম। গ্রামের নাম কালুয়া মাফি। কী নাম! শুনলেই মনে হয় এখানে মাফিয়ারা থাকে।

সন্ধ্যে হয়ে আসছে। তপ্ত দুপুরের প্রবল ল্যু ততক্ষণে একটু মোলায়েম হতে শুরু করেছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় চাচেরা ভাই রামসুন্দরকে খুঁজে বার করা খুব একটা কঠিন হল না।

তার বিরাট হাভেলি টাইপের বাড়ি। সদরে আবার পাগড়ি মাথায় সেন্ট্রি ! কাঁধে বন্দুক। আর আছে ঠোঁটের ওপর তেল চপচপে পাকানো গোঁফ । দেওয়ালে ঝোলানো মশালে কেউ একটু আগেই আগুন দিয়েছে।

মিস্টার রামসুন্দরবাবুর সাক্ষাৎপ্রার্থী শুনে বন্দুকওয়ালাদের যুগল ভুরু প্রায় কপালে উঠে গেল।

তাদের মধ্যে যে বুদ্ধিমান, সে বলে উঠল, ইহা পে সিস্টার মিস্টার কোই নেহি হ্যায়। আমরাও প্রায় লাফিয়ে উঠে বললাম, ভোপাল সে সুখবিন্দর সিং নে হামকো ভেজা। বহুত জরুরি কাম হ্যায় রাজাকে সাথ। এবার  কাজ হল। দুজনের একজন ভিতরে চলে গেল। সদর দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, ইঁয়া গোঁফওয়ালা টিংটিঙে একটা লোক খাটিয়ায় বসে ঘটিতে করে কী যেন খাচ্ছে। হাত নেড়ে আমাদের ভিতরে আসতে বলল। আমার সঙ্গী দিব্যজ্যোতির গোফটি ছিল ভারি সুন্দর। ঠোঁটের উপর যেন ল্যাজ ঝোলা এক পাখি। ভিতরে যেতে যেতে দেখলাম দিব্য নিজের গোঁফে আলরেডি তা দিতে লেগে গেছে। যেন এত রঙবাজি তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। দিব্যর গোঁফের কারণেই হোক বা অন্য কোনও কারণে রামসুন্দরের মেজাজটা দেখলাম ঠিক সুবিধার নেই।

কিন্তু আতিথেয়তায় কোনও খামতি নেই। সামনে রাখা একটা খাটিয়ায় আমাদের বসতে বলে, চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেয়া চাহিয়ে? আমরা  তৎক্ষণাৎ দাদা সুখবিন্দরের চিঠি তার হাতে তুলে দিলাম। সে একবার চিঠির একটা করে লাইন পড়ে আর আমাদের দিকে তাকায়। চোখে একইসঙ্গে বিরক্তি ও বিস্ময়। তারপর একেবারে হিন্দি সিনেমার স্টাইলে হাততালি দিল। পাগড়ি আর কাঁধের বন্দুক সামলাতে সামলাতে একজন দৌড়ে এল। বলল, জী রাজাসাব? রামসুন্দর ওরফে এক স্বঘোষিত রাজা আমাদের তোয়াক্কা না করেই চামচাটিকে বলল, ইয়ে লোগ মেরা মেহমান হ্যায়। উনকো ঠাণ্ডা সরবত পিলাও। দু তিন মিনিটের মধ্যেই দুটো ঝকঝকে পিতলের ঘটিতে ঠাণ্ডা সরবত চলে এল। সঙ্গে বড় থালাতে খান দশেক লাড্ডু। রাজা সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, পিলো বেটা। ইতনি গরমী মে দিমাগ ঠাণ্ডা হো যায়গা। দিব্য খুব মিষ্টি ভালবাসে। সে প্রথমে লাড্ডু তুলে নিয়ে মুখে পুরল। আমি ঠাণ্ডা সরবত। দু ঢোঁক মারার পরেই বুঝলাম এ তো যে সে সরবত নয়। পিওর ভাঙ। খেতে দারুন। কিন্তু দিব্য? আমি দিব্যকে চিমটি মেরে ফিসফিস করে বললাম, এটা ভাঙ। দিব্য খচে লাল। জলের বদলে ভাঙ? ও ঘটি হাতে নিয়ে গুম মেরে বসে রইল। পাছে রাজামশাই রেগে যান তাই আমি ঢকঢক করে ভাঙের ঠাণ্ডাই প্রায় শেষ করে দিলাম।

কলেজ জীবনে একবার বন্ধুবর সূর্য ঘোষ ভাঙ খাইয়েছিল। তখন মিনার্ভা থিয়েটারের সামনে ভাঙের সরবত পাওয়া যেত। সে নেশা আমার তিনদিন পরে কেটেছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে আর যাই খাই, ভাঙ খাব না। কিন্তু সে শপথ রাখতে পারলাম কই? রাজা সাহেব আমাদের সঙ্গে বাবা ঘনশ্যামের দেখা করিয়ে দেবেন, আর তার কথায় আমি একটু ভাঙ পিতে পারব না?

রামসুন্দর দিব্যর দিকে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেশ করলেন, পিতা নাহি কিউ?

প্রশ্ন শুনে আমার সদ্য নেশা ব্রহ্মতালু দিয়ে যেন ফুস করে আকাশে উড়ে গেল। শুনলাম দিব্য বলছে, ইয়ে পানি নেহি হ্যায়, ভাং হ্যায়। আপকো পহলে বোলনা চাহিয়ে থা! ম্যায় নেহি পিয়েঙ্গে। আপ আপকো কেয়া সমঝতে হো!

মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম রাজা সাহেবের হাতে একটা পিস্তল। ছ ঘড়া। ইধার মেরা হুকুমত চলতা হ্যায়। মু সামহাল কে বাত করো।

সামান্য যতটুকু নেশা তখনো সেরিব্রাল করটেক্সে আটকে ছিল ততটুকু সম্বল করে যেন বাতাসে ভড় করে উড়ে গিয়ে পড়লাম রাজাসাহেবের কোলে। ভয়ঙ্কর বিপদের সম্ভাবনা মাথায় রেখে হাউ মাউ করে কেঁদেই ফেললাম। বললাম, রাজা জি ইনকো মাত মারো। ও আমেরিকা মে রহতে হ্যায়। উধার ভাং নেহি মিলতা হ্যায়। আভি কলকাত্তা মে আয়া। ভাং পিনে সে ও মর যায়গা তো? হামকো খাওয়াও। জিতনা খুশ।

আমার হিন্দি শুনেই হোক বা অন্য কোনও কারনে রাজা সাহেবের দিমাক ঠান্ডা হল। আমায় কোল থেকে নামিয়ে অভিমান ভরা গলায় বললেন, ইয়ে বহুত ডেঞ্জারাস জায়গা হ্যায়। মেরা বাত সুনকে চল। নেহি তো হাম বাবাকে পাশ নেহি লে যায়গা।

আমি তার পায়ে প্রনাম করে বললাম, আশির্বাদ দি জীয়ে রাজা সাব। আপ জো বোলেগে তাই হোগা।

রাজাসাব এবার খুশ হলেন। বললেন, অউর ঠান্ডি পিওগে? আমি নাচতে নাচতে বললাম , কিউ নেহি?

তারপর চলল আরেক প্রস্থ ঠান্ডি পান।

রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম একটা হাড়ি কাঠে মাথা দিয়ে বসে আছি। সামনে পার্থদা যেন বাবা ঘনশ্যাম হয়ে কটকট করে আমার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে কি সব মন্ত্র পাঠ করছে।

দিব্যজ্যোতির খেল দেখা গেল পরের দিন। প্রেসিডেন্সিয়ান দিব্য প্রায় পঞ্চাশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এতটুকু টস্কায়নি। বরঞ্চ আমি ফেরার সময় কারো একটা কাধে করে ফিরেছিলাম। আসলে ঠিক সে সময়েই ভাং এর নেশাটা আমার কেটে গেছিল। তারপরেই আমি ধপাশ।

ক্রমশ 

Related Posts

Leave a Reply