কৃষ্ণ অর্জুন সংবাদ ২
।। রজত পাল ।।
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা শেষে ৫ ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণকে অনুসরণ করে কৃষ্ণ তার পিসতুতো ভাই পান্ডবদের দেখা পেলেন। এর আগে বারনাবতের জতুগৃহ থেকে এদের খোঁজ করছিলেন। পান্ডবরা এ পর্যন্ত বিশেষ কিছু করে উঠতে না পারলেও কৃষ্ণ কংসকে বধ করে যদুবংশে আবার গণতন্ত্র ( নামমাত্র উগ্রসেন রাজা) স্থাপন করেছেন। বিনিময়ে জরাসন্ধ ২১ বার মথুরা আক্রমণ করায় ( প্রতিবার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মোট সৈন্যের থেকে বেশী সৈন্য নিয়ে)। ফলতঃ দ্বারকাতে নতুন করে বসতি স্থাপন করতে হয়েছে। সবই কৃষ্ণের নেতৃত্বে।
ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপন করতে কৃষ্ণ যখন হস্তিনাপুরে তখন পার্শ্ববর্তী অসুর রাজা দ্বারকা তছনছ করে দিয়ে গেছে। ফিরে এসে সেই লড়াই নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে পাশাখেলার সময় থাকতে পারলেন না। দ্রৌপদীর গঞ্জনাও শুনতে হল এর দরুন। এছাড়াও নরকাসুর, মুচকুন্দ ইত্যাদি কতোজনের সাথে যে কৃষ্ণকে লড়াই করতে হল ( রুক্মিনী কে বিবাহ জনিত লড়াই, সমন্তক মণি নিয়ে লড়াই – এসব ছোটখাটো লড়াই বাদ-ই দিলাম) তার বিবরণ ভাগবতে বা হরিবংশে পাওয়া যায়।
কই, কোনও লড়াইতে তো পান্ডবদের কৃষ্ণের পাশে দেখা গেল না। বলা যেতে পারে পান্ডবরা নিজেরাই তো ঘুরে মরল, ওরা আর কি সাহায্য করবে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার আগে প্রায় ১৫/২০ বছর পান্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করেছে। এর মাঝে রাজসূয় যজ্ঞ করা হয়েছে। সে সময়ও কৃষ্ণ পাশে ছিল । যুধিষ্ঠির কে রাজচক্রবর্তী সম্রাট বানাতে জরাসন্ধের ডেরায় গেলেন (যে কিনা কৃষ্ণ কে তার জামাতা কংসের হত্যাকারী হিসাবে কখনই ক্ষমা করেনি)। শিশুপালকে বধ করলেন। দরকার পরলেই কৃষ্ণের দ্বারস্থ হলেও কৃষ্ণের crisis এ ?
নিজের প্রাণ সংশয় হবার ঝুকি নিয়েই হস্তিনাপুরে দূত হয়ে গেছিলেন কৃষ্ণ পান্ডবদের হয়ে কথা বলতে। তারপর ? অত্যন্ত কূট বুদ্ধির অধিপতি সেই কৃষ্ণ ঘুমিয়ে থাকার ছলনা করে অর্জুন এবং দুর্যোধন দুজনকেই যুদ্ধে সহায়তার আশ্বাস দিলেন কেন? মনে রাখতে হবে , এর কিছুদিন আগেই হস্তিনাপুরে কৃষ্ণকে আটক করার চেষ্টা করেছিলেন দুর্যোধন। তার মতন বীর নিজে যুদ্ধ করলেন না। উপরন্তু কৌরব পক্ষকে তার “সংশপ্তক” ( গেরিলা কমান্ডো বাহিনী) দান করলেন।
কিন্তু কেন ? সারাজীবন ন্যায়ের পথে চলা কৃষ্ণ খুব সহজেই তো ধর্মযুদ্ধে পান্ডবপক্ষে সসৈন্যে যোগ দিতে পারতেন। কেন ? অভিমান ? একতরফা দিয়ে দিয়ে ক্লান্তি ? নাকি গোষ্ঠী বিবাদ এড়ানো ? মহান মানুষদেরও যে মন বলে একটা বিষয় থাকে আমরা কি মনে রাখি ?
এমন politically correct হয়েও কি তিনি বদনাম এড়াতে পারলেন ? এ আপেক্ষিক নিরপেক্ষতা কি শুধুই নীতি? নাকি পান্ডবদের প্রতি নীরব প্রতিবাদ । অথচ ন্যায়ের পথ ছাড়লেন না। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী তো তাকে ক্ষমা করেননি। নিজের দাদা বলরামও তো তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কৃতবর্মা, সত্রাজিৎ, অক্রুররা তো সর্বদাই কৃষ্ণ বিরোধী ।
কি পেলেন কৃষ্ণ ? কৃষ্ণ বলতেই আমাদের কাছে বাঁশি হাতে রোমিও pattern এর এক নারী লোলুপ মানুষের ছবি ভেসে আসে । তিনি রাধাকে প্রেমে নিঃস্ব করে মথুরা চলে গেলেন চিরকালের মতন। অথচ ভাগবত বা কোন পুরাণে ‘রাধা’ বলে কোন চরিত্র নেই । মধ্যযুগে ভক্তিবাদীরা রাধা চরিত্র কল্পনা করেন। রাধা-ই নেই, তায় তার স্বামী আয়ান গোপ। বলতেই পারেন রাস-ঝুলনে গোপীদের সাথে কি flirt করেননি ? বুঝতে হবে গোপালকদের জীবন শৈলিতে এ অস্বাভাবিক নয়। আর কৃষ্ণ তখন নিতান্তই কিশোর মাত্র । মধ্যযুগ অবধি ‘বসন্ত উৎসব’ জাতীয় free মেলামেশার উৎসব সারা পৃথিবীতেই ছিল ।
বলবেন, তবে যে ষোল হাজার উপপত্নী ? নরকাসুরের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া এই রমনীরা যেতেন কোথায় ? কে বা কারা তাদের বিবাহিত স্ত্রী -র মর্যাদা দিত ? অরক্ষনীয়ারা কোন সমাজেই বা ভালো থাকেন ? কৃষ্ণ যে তাদের প্রয়োজনে পছন্দের পুরুষ গ্রহনের অধিকার দিয়েছিলেন এ কথা আমরা ভুলে যাই । ওনারা মোটেই কৃষ্ণের হারেমে বন্দী ছিলেন না । নারীসুরক্ষার যে প্রয়োজন ছিল তা মুষল পর্বের পর দস্যু কর্তৃক যাদব নারীহরণ থেকেই প্রমাণ হয়।
এরপরও বলবেন, আটখানা বিয়ে করেছিল যে? একটু খবর নিলেই দেখবেন কৃষ্ণ কাউকেই কামনা করেননি । রুক্মিনী, সত্যভামা বা জাম্ববতী সকলেই ঘটনাক্রমে তার স্ত্রী ।
সমসাময়িক ভারত তাকে প্রাপ্য সম্মান দেয় নি । আমরাও হয় ননীচোরা গোপাল, না হয় রাধা- কৃষ্ণ যুগলে পূজা করেছি । তার বীরত্ব, সততা, বুদ্ধি মত্তা, পরোপকার এবং সর্বোপরি ন্যায় -পরায়নতা কে কি সম্মান করেছি ? তার নির্লোভ মনোবৃত্তিকে কি কুর্নিশ করেছি ? চাইলে কি তিনি কংস বধের পরে মথুরার রাজা হতে পারতেন না?
একমাত্র বন্ধু অর্জুন তাকে সম্মান দিয়েছেন। মহাযুদ্ধে কৃষ্ণ লড়াই করবেন না শুনেও তাকেই পাশে চেয়েছেন, তার সৈন্য নয়। যুধিষ্ঠীর যখন রাজত্ব ভোগ করেছেন তখন অর্জুন সত্য রক্ষার জন্য একাকী ১২ বছর বনবাসে কাটিয়েছেন। ফলে কৃষ্ণের পাসে থাকার সুযোগ ঘটেনি। যদুবংশের সকলের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বোন সুভদ্রা সাথে অর্জুনের বিবাহ দিলেন। মুষল পর্বের পর অর্জুনই এসেছিলেন যাদব রমনী ও শিশুদের রক্ষা করতে। বন্ধুকৃত্য করেছেন। বলা হয় কৃষ্ণ-অর্জুন পুর্বজন্মে নর-নারায়ণ নামে জন্ম নিয়ে তপস্যা করেছিলেন। হতে পারে তাদের এই বন্ধন পুর্বজন্মের।
এদিকে অর্জুন, 12 বছর অবধি বদ্রির কাছে জঙ্গলবাসী। হস্তিনাপুরে এসে একনিষ্ঠ অস্ত্রশিক্ষা, তারপর জতুগৃহ থেকে পালিয়ে ভ্রমণ । যুধিষ্ঠীর যখন রাজা, তখন 12 বছর পরিব্রাজক। দেবতাদের হয়ে যুদ্ধ, ফিরে এসেই বনবাস ও অজ্ঞাতবাস। আগে পরে দাদার জন্য রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য লড়াই । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তো আছেই । মণিপুর রাজ্যের রাজত্ব এবং চিত্রাঙ্গদার প্রেম ছেড়ে এলেন কর্তব্যের আহ্বানে । তিনি কি পেলেন ? আফসোস পর্যন্ত করলেন না । No complain.
তবে এখানে একটা প্রশ্ন মনে এসেছে, আগের জন্মে ঘোর তপস্যা করার পরেও মুক্তি বা মোক্ষ লাভ না হয়ে পরের জন্মে রজোগুণী ক্ষত্রিয় হয়ে কেন জীবন কাটাতে হল কৃষ্ণ-অর্জুন কে ? জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার এর বিচার করা সত্যই দুস্কর । দুজনেই এই জন্মে নির্লোভ কর্মবীর ও ধর্মরাজ্য স্থাপনে একনিষ্ঠ যোদ্ধা । একজন্ম তপস্যা করে পরজন্মে রণনিপুন ক্ষত্রিয়। কর্মবন্ধন তথা প্রারব্ধ না কাটিয়ে যে মুক্তি নেই । নর-নারায়ণ কাহিনী গালগল্প হতে পারে, তবে পূর্ব জন্মের সংস্কার না থাকলে এমন নির্লোভ নিরাসক্ত ভাবে কর্মবীর কি হওয়া যায় ? কি জানি ।