অমিতাভ-রেখার মতন আরো একটি অসম্পূর্ণ বৃত্ত মিঠুন-শ্রীদেবী
লেখক- কুনাল ঘোষ
মিঠুনদার সঙ্গে অনেকদিন আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তবে আজ শ্রীদেবীর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। ছটফট করছে। মুখফুটে কতটা বলতে পারবে আমি জানি না। কিন্তু আজ যার হৃদয়ে প্রবল রক্তক্ষরণ, তার নাম মিঠুন চক্রবর্তী।
মিঠুন-শ্রীদেবী সম্পর্ক ছিল। টান ছিল। ভালোবাসা ছিল। হিন্দু রীতিতে বিয়ে ছিল। কিন্তু জীবনের অবাক যাত্রাপথ দুজনকে আলাদা করেছে। মিলিত হতে না পারলেও পরস্পরকে সম্মান দিয়েছেন। কোনো তিক্ততা আসতে দেন নি। পরম যত্নে দৈনন্দিন জীবন থেকে আড়ালে রেখেছেন সম্পর্ক। যোগাযোগ না থাকলেও গভীর অনুভূতিটা হারিয়ে যেতে দেননি।
মিঠুন-শ্রীদেবী সম্পর্ক আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই মিডিয়ায়। কিন্তু এটা যে শুধু তারকাজনিত টাইম-পাস ছিল না, বুঝেছি অনেক পরে। মিঠুনদার সঙ্গে ভালোমত আলাপের পর।
আজ শ্রীদেবীর মৃত্যুসংবাদ শুনেই কেন জানি না হঠাৎ মনে পড়ল ২০০২ সালের এক মধ্যরাত। সল্ট লেকের ফ্ল্যাটের ঘর। মিঠুনদা আর আমি। অকপট মিঠুনদা সেদিন শ্রীদেবী সম্পর্কে মনের দরজা খুলে দিয়েছিল। সবটা লেখার নয়। সবটা মনেও নেই। কিন্তু, সেদিন তারকার মোড়কের ওপাশে দেখেছিলাম এক রক্তমাংসের পুরুষকে। যে কাতর প্রেমিক। যে রোজকার জীবনের ব্যস্ততা, বিলাস, বৈভবের মধ্যেও সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে কিছু মুহূর্ত, তার মনের মণিকোঠায়। বাস্তবকে মানতে গিয়ে নিজে হাতে হত্যা করেছে এক মনের টানের সম্পর্ককে।
শ্রীদেবীর সঙ্গে মিঠুনদার যখন সম্পর্ক, তখন মিঠুনদা যোগিতাভাবীকে বিয়ে করেছে। বড় ছেলে মিমো এসেছে।
এমন সময়ে মিঠুন-শ্রীদেবী সম্পর্ক। সুপারহিট জুটি। পরপর হিট। দক্ষিণ থেকে আসা শ্রীদেবী ঝড় তুলেছেন। আর বঙ্গতনয় মিঠুন বলিউডে প্রতিষ্ঠার সব ব্যাকরণ ভেঙে নিজস্ব অভিধান চালু করেছেন। পর্দার জুটি ক্রমশঃ পর্দার বাইরেও।
সব জানতেন মিঠুনদার বন্ধু তথা দাদা অধুনাপ্রয়াত গৌতমদা আর শ্রীদেবীর বোন। দুই নক্ষত্রের একান্তে দেখার আয়োজন সম্ভবত তারাই করতেন।
এখান থেকেই আরও গভীরতা। এবং শেষে একটি বিশেষ মন্দিরে হিন্দুমতে বিয়ে। তিনদিনের মধুচন্দ্রিমা।
এর পরেই আশ্চর্য ধর্মসংকট। স্বাভাবিকও বটে।
শ্রীদেবীর বক্তব্য, মিঠুনদাকে পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। শ্রীদেবীর দিক থেকে এটা সঠিক দাবি।
কিন্তু মিঠুন স্ত্রী, পুত্রকে ছেড়ে বেরোতে পারলেন না। বাবা, মাও মিঠুনকে সমর্থন করলেন না। মিঠুন সময় চাইলেন শ্রীদেবীর কাছে।
প্রবল মিঠুনপ্রেমে পাগলপারা শ্রীদেবী মিঠুনকে সময় দিলেন মাত্র ৪৮ বা ৭২ ঘন্টা। বাড়ি ছেড়ে আসার। অন্যথায় শ্রীদেবী অপেক্ষা করবেন না।
শ্রীদেবীর এই চাপটা ছিল গভীর প্রেম থেকেই। মিঠুনকে নিজের মতো করে পাওয়ার জন্য। কিন্তু এই সময়সীমাটাই যেন ব্যক্তিগত সম্পর্কের সীমা ছাড়িয়ে দুই সুপারস্টারের ইগোর সংঘাতে পরিণত হল। মিঠুন সময়ের চাপ মানতে পারলেন না। শ্রীদেবী সরে গেলেন।
শুনেছি, যখন ‘অন্যায় অবিচার’ ছবির শ্যুটিং চলছে দীঘার কাছে, তখনও শ্রীদেবীর বোন কলকাতা এসে মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু তখন দুই মহাতারকাকে আর মেলানো সম্ভব হয়নি।
এরপর মিঠুন মুম্বাই ছেড়ে উটিতে সাম্রাজ্য বসান।
মিঠুন-শ্রীদেবী প্রেম অসম্পূর্ণ থেকে রাজকাপুর-নার্গিস বা অমিতাভ-রেখার জুটির তালিকায় ঢুকে যায়।
এই সম্পর্কে কিছু ঠিক, কিছু ভুল, কিছু প্রশ্ন যে কেউ তুলতে পারেন। কিন্তু ঘটনা হল, সম্পর্ক আর মনের মিল নীতিকথা মেনে হয় না, এটা বাস্তব।
মিঠুনদা মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিল শ্রীদেবীকে, বাস্তব।
শ্রীদেবী মিঠুনদাকে চেয়েছিলেন, এটাও বাস্তব।
আর সবচেয়ে কঠিন বাস্তব, যে কোন কারণেই হোক, দুজনকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে।
দুজনে ব্যস্ত থেকেছেন আলাদা বৃত্তে। মিঠুন পেশাগত লড়াইতে, নানা কাজে, পারিবারিক কর্তব্যপালনে। শ্রীদেবী বনি কাপুরকে বিয়ে করে দূরের সংসারে।
সময় পেরিয়েছে। দুজনে আলাদা কক্ষপথে রেখেছে নিজেদের। দায়িত্বশীলভাবে। অতীতকে প্রকাশ্যে এনে বর্তমানের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটির ভারসাম্য নষ্ট করেনি কেউ। শুধু মনের মধ্যে রয়ে গেছে পরস্পরের প্রতি সম্মান আর ফেলে আসা মুহূর্ত।
আজ যখন মিঠুনদা হঠাৎ খবর পাবে “শ্রী” নেই, আমি নিশ্চিত, এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠবে ও।
অসম্পূর্ণ সম্পর্কের অভিমানী সহযাত্রীর চিরবিদায়ের ধাক্কা সামলাতে খুব কষ্ট হবে মিঠুনদার।