খালি হাতেই এই মহিলারা যেভাবে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, তা জানলে চমকে উঠবেন
[kodex_post_like_buttons]
কলকাতা টাইমস :
১২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক মণিপুরী নুপীলাল (নারী বিদ্রোহ) দিবস পালন করা হয় । ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মণিপুরী নারীদের দ্বারা সংঘটিত নারী বিদ্রোহ, যা মণিপুী নুপী লান নামে পরিচিত আজও ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে আছে। ভারতের মণিপুর রাজ্যে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে এটিই ছিল প্রথম নারীদের অস্ত্র হাতে তুলে সম্মুখ যুদ্ধ।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের শোষণমূলক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা মণিপুরের সাহসী নারী বিদ্রোহ (নুপিলাল) মণিপুরী নারীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। এই নারী বিদ্রোহ ইতিহাসে মণিপুরী নারীদের সাহস ও নেতৃত্বের সাক্ষ্য দেয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পর থেকে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা, নির্যাতন, বৈষম্য দমন ও সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে মণিপুরী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলন মৈরা পাইবী এখনো সক্রিয় রয়েছে।
মণিপুরীরা প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর ‘নুপীলান দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে। বিশ্বের সব স্থানেই মণিপুরীরা এই দিবস সশ্রদ্ধচিত্তে দিবসটি পালন করে থাকেন। ভারতের বাইরে বাংলাদেশে সিলেট বিভাগের সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলার মণিপুরীপাড়াগুলোতে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। এবার ৮৩ তম নুপীলান দিবস পালন করছেন মণিপুরীরা। এই দিনে তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে সেদিনের সংগ্রামী ও সাহসী নারী নেত্রীদের। যারা ব্রিটিশ সৈন্যের রাইফেল বেয়োনেটের বিরুদ্ধে খালি হাতে সম্মুখ সংগ্রামে নেমেছিল এবং ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। আজকে জেনে নিন, তাদের সংগ্রামী জীবনের নানা কথা।
মণিপুরের ইতিহাস
ভারতের মণিপুর রাজ্যে মেইতিরা মণিপুরে সংখ্যাগুরু জাতিগোষ্ঠী। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে ৩৩ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরে নিংথৌজা রাজবংশের সুত্রপাত হয়, তা অব্যাহত থাকে ১৮৯১ সাল অবধি। সেই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লাইরেন পাখাঙবা ও তার রানি লেইমা লেইসনা। তাদের রাজধানী ছিল ইম্ফল উপত্যকার মাঝে অবস্থিত কাংলায়। মণিপুরের তিন ধর্মের মানুষের আগমণ ঘটে মণিপুরে। এসময়ে ‘পাঙাল’ বলে পরিচিত মুসলমান ও কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ পুরুষ সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে, তারা মূল জনগোষ্ঠির সঙ্গে মিলে যান। তখন থেকেই কাংলা সেখানকার জনগণের আরাধ্য স্থান রাজতান্ত্রিক মণিপুর রাজ্য সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয় বার্মিজ রাজ্য দ্বারা। ১৮১৯ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত বার্মা ও মণিপুরের মধ্যে যে একটানা যুদ্ধ চলে, সেই যুদ্ধকে বলা হয় সপ্তবৎসরের ধ্বংসকাণ্ড। আর এ যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মহারাজার বাহিনীকে সহায়তা করায় চুক্তির শর্তমতো ‘কবো উপত্যকাটি’ ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ১৮৯১ সালের ২৭ এপ্রিল খোঙজমের নির্ধারক যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সেখানে ইংরেজ শাসন কায়েম হয়। অসংখ্য মুক্তিকামীদের সেসময়ে হত্যা করা হয়, অথবা নির্বাসনে পাঠানো হয়। জনগণের আরাধ্য স্থান কাংলার জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। রাজতন্ত্রের পতনের পর শুরু হয় ঔপনিবেশিক শাসন, আর জনগণ হতে থাকে আরও বেশি শোষিত। ১৯০৪ এবং ১৯৩৯ সালে দু’বার মণিপুরী নারীরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল, আন্দোলন-সংগ্রামে কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের ভিত। সফল এ নারী বিদ্রোহের চূড়ান্ত সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১২ ডিসেম্বরে এবং বিজয় অর্জন করেছিল। স্মরণীয় হয়ে রইলো ১২ ডিসেম্বর মণিপুরের ইতিহাসে প্রখ্যাত নুপীলান অর্থাৎ নারীবিপ্লব নামে পরিচিত।
প্রথম নারী আন্দোলন
১৭৮১ সালে মণিপুর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। শিগগির মণিপুর ব্রিটিশদের কর রাজ্যে পরিণত হয় এবং মণিপুর রাজ্যকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাৎসরিক কর প্রদানে বাধ্য করে। পরবর্তীতে ফ্রি ট্রেড পলিসি নীতির বদৌলতে মণিপুর থেকে প্রচুর খাদ্যশস্য বাহিরে রপ্তানি করতো। ফলে মণিপুরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর প্রতিবাদস্বরুপ উত্তাল জনগণ খ্বাইরমবন্দ বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সম্পূর্ণ ভষ্মীভূত করে। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বাংলো জ্বালিয়ে দেয়। পরবর্তীতে বাংলোগুলো পুননির্মাণের জন্য আদেশ জারি করা হয় এতে মণিপুরের নারীপুরুষ ক্রোধান্বিত হয়ে ফেটে পড়ল। সংঘটিত হলো ১৯০৪ সালের প্রথম নারী আন্দোলন। হাজার হাজার রমণী রুখে দাঁড়ালো তাদের অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সশস্ত্র সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিল। আহত হন অনেক নারী আন্দোলনকারী। যদিও এই আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার অন্যায় আদেশ প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় নারী আন্দোলন
১৯৩৯ সালের নারীবিদ্রোহের মূল কারণ ছিল ২টি। ১) শাসকচক্রের ঘৃণ্য কপটনীতি এবং ২) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী। মারোয়াড়িরা ছিল মজুতদার, মুনাফাখোর, কালোবাজারী। তারা চড়াদামে খাদ্যশস্য ক্রয় করে গুদামজাত করত এবং বাহিরে রপ্তানি করতো। ফলে তখন মণিপুরে খাদ্যসংকট প্রকটভাবে দেখা দেয়। এ ব্যাপারে সরকারি কর্মচারীগণের সহযোগিতা ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষ। দেশের অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু অনাহারে প্রাণ হারায়। এমন অবস্থায় মণিপুরের বীর নারীসমাজের বুকে জলে উঠলো বিদ্রোহের দাবানল। হাজার হাজার মা-বোন প্রকাশ্য রাজপথে গগণ বিদারিত শ্লোগানে এবং তাদের হাতে যা আছে তা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। ভেঙে ফেলা হলো সরকারি গুদাম। এই পরিস্থিতিকে দমন করতে তলব করা হলো আসাম রেজিমেন্ট সিপাহীদের। তাদের অত্যাচারে পরিণত হয় এক নারকীয় পরিবেশ। তাদের বেয়নেটের খোচায় ক্ষতবিক্ষত হন অগণিত মণিপুরী নারী। তৎকালীন নারীসমাজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল।
দ্বিতীয় নারী আন্দোলন ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। মূলত দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে, ১৯৪২ সালের ১০ মে সাম্রাজ্যবাদী জাপান ইম্ফলে বোমা বর্ষণের পর দ্বিতীয় নুপিলান স্তব্ধ হয়ে পড়ে। তবে এর রেশ রয়ে যায় পরবর্তীতে গড়ে উঠা সব আন্দোলন সংগ্রামে। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট মণিপুরের মহারাজা বোধ চন্দ্র আর ইংরেজ সরকারের গভর্নর জেনারেল লুই মাউন্টব্যাটনের মধ্যে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে মণিপুর রাজ্যকে ডোমিনিয়ান, স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মণিপুর একটি স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়। ১৯৪৮ সালে গণভোটের মাধ্যমে মণিপুরের জনগণ রাজাকে সাংবিধানিক প্রধান নির্বাচিত করে, রাজার অধীনে একটি সরকার শপথ গ্রহণও করে।
বিদ্রোহী সংগ্রামের মুসলিম নারীদের অবদান
১২ ডিসেম্বর শত সহস্র প্রতিবাদী মণিপুরী নারী ধান রপ্তানি বন্ধের দাবিতে রাজ্যের দরবার হলের দিকে পদযাত্রা শুরু করে। মিছিলটি যতই অগ্রসর হতে থাকে ততই এর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইম্ফলের পার্শ্ববর্তী এলাকার বহু মুসলিম মণিপুরী নারী উক্ত প্রতিবাদী মিছিলে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশ সেনারা শীর্ষ মণিপুরী নারী নেত্রীদের ১০ জনকে বন্দি করা হয়। এদের মধ্যেই মণিপুরী মুসলমান পাঙাল ৩ জন নারী ছিল-তারা হলেন ১. মিসেস সারা বিবি, স্বামী জনাব নুর আলী, ক্ষেরগাঁও, সাবাল লাইকাই ২. মিসেস তমবি বিবি, স্বামী জনাব ইব্রাহিম ৩. মিসেস সজাওবি বিবি, স্বামী জনাব নুর আলী, ক্ষেত্রী আওয়াঙ।
এ আন্দোলনে যেসব মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল) নারী সাহসী ভূমিকা পালন করেন তাদের তালিকা যা খৈরুদ্দিন পুখ্রীমায়ুম কর্তৃক মণিপুরী ভাষায় প্রকাশিত হয়। সেখানে ৩২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মনিপুরি নারীদের দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধ নারী বিদ্রোহ (নুপী লাল) মণিপুরি মুসলিম পাঙাল নারীরা ১ম এবং ২য় নারী বিদ্রোহ (নুপীলালে) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তবে আজ পর্যন্ত এই ভূমিকা স্বীকার করেননি মণিপুরের রাজ্য সরকার। মণিপুর সরকার কর্তৃক নারী বিদ্রোহীতে (নুপীলাল) অংশ নেওয়া মুসলিম মায়েদের স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে ভারতে মণিপুর রাজ্যের বিশিষ্ট মুসলিম নারী নাগরিক সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম ইউনাইটেড মণিপুরী মুসলিম উইমেন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের আয়োজনে নারী বিদ্রোহী (নুপিলাল) দিবসটি প্রতিবছর একদিন আগে ১১ ডিসেম্বর নুপীলাল দিবস পালন করে স্বীকৃতি দেওয়ার আহবান জানানো হয়। মণিপুরে যেসব নারীদের নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন তাদের মধ্যে মুসলমান ছিলেন অনেক নারী। সুতরাং ইতিহাসের থেকে এই বিপ্লবীদের মুছে ফেলা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আজ আমরা ও তৎকালীন নারীদের সমাজের জন্যে তার এই মহান ঐতিহাসিক বিদ্রোহকে সম্মান জানানো দরকার।
মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মৈরা পাইবি নারীরা
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন পর মণিপুরি নারীরা সহজে হাল ছাড়েননি। পুরুষতন্ত্রের ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অসাম্যের বিরুদ্ধে একটি জনগােষ্ঠীর যে লড়াই থাকে, মণিপুরীরা এই লড়াইয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। মণিপুরীদের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তোলে মৈরা পাইবি নামে সচেতন নারীদের সংগঠনের। ‘মৈরা পাইবী’ অর্থ মশালবাহী। এ সংগঠন পাড়া বা এলাকাভিত্তিক হয়ে থাকে তাদের প্রধান কার্যক্রম মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সমাজের অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা এবং যুবসমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করা এবং নারী নির্যাতন, নারীদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক কাজ, মদ, জুয়া এসব প্রতিরোধ করা।
বর্তমান সময়ে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা, নির্যাতন বন্ধ করতে হলে নারী নির্যাতন বিরোধী সব আন্দোলনকে বৈষম্য ও দমনমূলক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে মণিপুরী সচেতন নারীদের মৈরা পাইবী সংগঠনকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশে বসবাসরত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা সমাজ সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ও সহিংসতা মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলে সহযোগিতা কামনা করেন।