ওমকার ভ্রমণ 3
বিপ্লব মজুমদার
ট্রেনের যাত্রী সকলেই নিন্মবৃত্ত নিন্মবিত্ত পরিবারের এবং অল্পবয়সী l সবাই যাবে নাগপুর l পাঁচ জনের সিট এ সাত জন বসে l দুই সিটের মাঝে চারজন বসে l অজানা কারণে একজন আমাকে একটু জায়গা দিয়ে বললো বসুন l আমায় নিয়ে সিট এ এবার আটজন দাঁড়ালো l কোনোরকম বসে আছি হঠাৎ দেখি সিটের তলা থেকে দুটো হাত আমার পা ধরে নাড়াচ্ছে l তাকিয়ে দেখি সিটের তলায় একজন শুয়ে l তীব্র গরমে সবাই প্রায় খালি গায়ে l
তীব্র কটু ঘামের গন্ধ তার সাথে গতদুদিনের অখাদ্য খাবারের পেট নিঃসৃত গন্ধ মিলে এক এমন বাতাবরণ তা বর্ণনা করা যাবে না l কেউ কোনো কথা বলছে না l কষ্টের দাপটে সবাই ঝিম মেরে আছে l বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা তাদের বাধ্য করছে প্রাণ শক্তি কে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে রাখা যায় l তাই সবাই এই মুহুর্তে এতো সহনীয় l নাহলে এটা সম্ভব নয় যে , যে যার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ছে, কারোর পা কারোর মুখের উপর আবার কারোর হাত কারোর পায়ের উপর l আমার কোলে দুজনের মাথা l আমার পায়ের পাতায় একজনের মাথা l কেউ যখন বাথরুমে যাচ্ছে তখন এর পায়ের উপর তো ওর হাতের উপর তো ওর মুখের উপর পা ফেলে যাচ্ছে … I
স্থির হয়ে বসে আছি l ক্ষুধা তৃষ্ণা বোধ নেই l এই অসহায় মানুষদের দিকে তাকিয়ে অপার করুণায় মন আর্দ্র হয়ে উঠলো l নিজের অজান্তেই দেখি কোলের উপর মাথাদুটিতে হাত বোলাচ্ছি l মনে মনে ঈশ্বরের মহিমা নিয়ে ভাবছিলাম l চিন্তাসূত্রে বাধা পড়লো একজনের ডাকে l
দাদা আপনি বাঙালি l
হ্যা l
কোথায় যাবেন ?
ওমকারেশ্বর l
একাই?
হ্যা l
তীর্থ করতে ?
হ্যা l
নাম কি ?
বিপ্লব l
আমার নাম পূজন সিংহ l ব্রাহ্মণ l বেনারস এ আমার বাড়ী l আমার খুব ইচ্ছা একবার কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে বসে সাধন করি l আপনি কি কালীঘাটে গেছেন ?
গড়গড় করে এতো কথা বলে গেলেন l
আমি বললাম হ্যা আমি কালীঘাটের কাছেই থাকি l এলে বলবেন l উনি এবার আমায় বলতে লাগলেন যে ” দেখো ভাই ! এই যে তুমি এই বয়সে সংসার ভালো লাগছে না বলে একটা অজুহাত দিয়ে একলা পথে বেরিয়েছ তার কোনো মানে হয় না l বাবা মা কে তীর্থ করাও এবং ধর্ম করো সপত্নীক l একা একা এই যে ঘুরে ঘুরে মরছ যার জন্য তা কি এ ভাবে পাওয়া যায় l মন শান্ত করো l ”
আমিতো পুরো বাকরুদ্ধ l আরও কিছু মামুলি কথাবার্তা বলতে বলতে ট্রেন খান্ডোয়া রোড ঢুকে পড়লো l ওনাকে বিদায় জানিয়ে ট্রেন থেকে অতিকষ্টে নামলাম l ঘড়িতে রাত পৌনে একটা l ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখি সহযাত্রী সবাই ক্রিমির মতো জড়াজড়ি করে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত l তারই মধ্যে একজনের চোখে ঘুম নেই যাকে আমি বিদায় জানিয়ে এলাম l ট্রেন যতক্ষন না ছাড়লো ততক্ষন দাড়িয়ে রইলাম l
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি অটো দাড়িয়ে l শুনলাম ওমকারেশ্বর যাবার কি ব্যবস্থা l রিজার্ভ করে গেলে দেড় হাজার টাকা লাগবে l নাহলে এখন বাস আছে l স্ট্যান্ড এ চলে যান l স্ট্যান্ড গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইন্দোরে যাবার বাস পেলাম যেটা ওমকারেশ্বর রোড এ নামিয়ে দেবে l সময় লাগবে একঘন্টা l বাস ছেড়ে দিলো যেন আমার জন্যই দাড়িয়ে ছিলো l চোখে একফোঁটা নিদ্রা নেই l ভাবছি এই জার্নি তে কি কি পেলাম?
প্রথমতঃ কিছু ইন্দ্রিয় চিরকালের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলো l ঘৃণা বোধ অনেকটাই চলে গেলো l আর ঈশ্বর অনুভূতি র কার মধ্যে আছে তা বোঝা খুব মুশকিল l এই সবই ভাবতে ভাবতে রাত আড়াইটে তে ওমকারেশ্বর রোড স্টেশনে এ নামলাম l একটা জনপ্রাণী নেই l একটা ম্যাজিক গাড়ী দাড়িয়ে l ভিতরে ড্রাইভার ঘুমাচ্ছে l ডাকতেই বললো সাড়ে চারটের সময় ছাড়বে l হাতে দু ঘন্টা l কি করি? স্টেশনে গিয়ে দেখি দু চারজন শুয়ে আছে l এক সাধুর পাশে র বেঞ্চে গামছা পেতে শুয়ে পড়লাম খোলা আকাশের নীচে l কতদিন বাদে যে এভাবে শুলাম তা মনে পরে না l আকাশ ভর্তি তারা ও নিঝুম পরিবেশ এর আবেশে চোখের পাতা নেমে এলো……l
ক্রমশঃ