ভূতের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পাননি বিশ্বকবিও, করতেন প্রেতচর্চা

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ পত্রিকার আশ্বিন, ১৩০১ সংখ্যায়, প্ল্যানচেট করার জন্য এক আশ্চর্যজনক ভৌতিক যন্ত্রের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল— ‘নির্মাতা শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্য, ১০৮, আপার চিৎপুর রোড, গরাণহাটা,কলিকাতা, মূল্য আড়াই টাকা, প্যাকিং ও ডাকমাশুল বারো আনা’৷ উত্তর কলকাতার কোনো বনেদি পরিবারে অনুসন্ধান করলে শতবর্ষ আগের সেই ঐতিহাসিক যন্ত্রের দু-একটা ভগ্নাংশও মিলবে কি না জানা নেই । কিন্তু বিজ্ঞাপন থেকে মনে হয়, যন্ত্রটির চাহিদা ছিল৷ অন্তত চিৎপুরের ঠাকুরবাড়িতে যে দু-এক পিস ঢুকে পড়েছিল, তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। কারণ, রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটির বাংলা নামকরণ করেছিলেন— ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযান’৷
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এইভাবেই যন্ত্রের সাহায্যে প্ল্যানচেট করে কবির সঙ্গে মাইকেল মধুসূদনের প্রথম আলাপ হয়েছিল। মধুসূদনের মৃত্যুর সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স ১২ বছর, সুতরাং সেই আলাপচারিতা তাঁর কৈশোরের অভিজ্ঞতা বলে ধরে নেয়া যেতে পারে কারণ সেই সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত প্রেতচক্র বসতো এবং কিশোর কবিরও সেই চক্রে বসার স্বাধীনতা ছিল৷ বিশ-একুশ বছর বয়সেও তিনি প্ল্যানচেট করতেন, তার লিখিত প্রমাণ রয়েছে৷ কিন্তু সেই চক্রের আয়ুও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কারণ, অন্যতম উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু।
অনেক বছর পরে, তখন তাঁর বয়স ৬৮ বছর, রবীন্দ্রনাথ আবার পূর্ণ মনঃসংযোগ করে পরিণত প্রজ্ঞার আলোকে পরলোকচর্চায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন৷ ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রেতচর্চায় অলোকসামান্য ক্ষমতার অধিকারিণী এক তরুণীর৷ সে বছর পূজা দেরিতে পড়েছিল, শরতের শেষ, আশ্রম জনশূন্য, রবীন্দ্রনাথ একাই ছিলেন উত্তরায়ণ ভবনে৷ তাঁর অতিথি হয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথের পুরোনো বন্ধু ও তাঁর বহু কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমা দেবী৷ কয়েক দিনের মধ্যেই কবির কানে খবর গেল, উমা একাধারে কবি এবং ভাল মিডিয়াম৷ রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ থেকে পেয়েছিলেন একটি তথ্য— এক ধরনের অতি-সংবেদনশীল মানুষ থাকেন, যাঁরা মৃত আত্মাদের আকর্ষণ করতে পারেন এবং তাদের সঙ্গে মরজগতের একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে পারেন৷ আধুনিক প্রেততত্ত্বের ভাষায় এঁদের বলা হয় ‘মিডিয়াম’৷ উমাদেবীর ভালো মিডিয়াম হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে জানতে পেরে কবি খুবই আগ্রহী হয়ে নিয়মিত চক্রের আয়োজন করেন৷ তিনি প্রেতলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সরাসরি মিডিয়ামের সাহায্য নিয়ে শুরু করলেন প্ল্যানচেট৷
প্রেতচক্রের যাবতীয় নিয়ম ভঙ্গ করে রবীন্দ্রনাথ উমার মুখোমুখি বসে তাঁকে প্রশ্ন করতেন৷ মিডিয়ামের হাতে কাগজ পেন্সিল থাকতো, তিনি উত্তর শুনে দ্রুত কথাগুলি লিখে কবিকে দেখাতেন৷ তাঁকে লিখতে সাহায্য করেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী আর মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়৷ ঘরে আরও অনেকে উপস্থিত থাকতেন, কিন্তু প্রশ্ন শুধু কবিই করতেন৷ এইভাবে আটটি ফুলস্কেপ কাগজের মোটামোটা খাতা ক’দিনে ভরে উঠেছিল৷ অক্টোবরের প্রারম্ভিক অধিবেশনগুলির কোন বিবরণ নেই, কিন্তু নভেম্বরে পর পর বেশ ক’দিন এবং ডিসেম্বরেও যে ক’দিন উমাদেবী শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তাঁকে কেন্দ্র করে পুরোদস্তুর প্রেতচক্র বসেছিল, যার বিবরণী শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে পরম যত্নে সংগ্রহীত রয়েছে৷ কবির ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন তাঁর প্রায় সমস্ত প্রয়াত আত্মীয় ও বান্ধবকুল৷
আত্মপরিচয় না দিয়েও একজন বার বার এসে পড়েছেন, তিনি নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী৷ এই মহামিলনচক্রের কথোপোকথন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে, তাঁর প্রিয় মানুষরাই তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে এসেছিলেন, যদিও তাঁর জীবিত নিকটজনরা অনেকেই মৃত আত্মাদের চক্রে আসা সম্পর্কে ততটা নিঃসন্দিগ্ধ হতে পারেননি৷ এঁদেরই একজনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— ‘পৃথিবীতে কত কিছু তুমি জানো না, তাই বলে সে সব নেই? কতটুকু জানো? জানাটা এতটুকু, না জানাটাই অসীম৷ সেই এতটুকুর ওপর নির্ভর করে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চলে না…যে বিষয় প্রমাণও করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, সে সম্বন্ধে মন খোলা রাখাই উচিত ৷ যে কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়াটাই গোঁড়ামি৷’
ভূতদের ষড়যন্ত্র থেকে বিশ্বকবিও রেহাই পাননি৷ রবীন্দ্রনাথের প্রেতচক্রের মিডিয়াম উমাদেবী, যাঁর হাত ধরে চুম্বকের মতো নেমে আসতেন পরলোকের বাসিন্দারা, ঠিক এক বছর পরে, ২২ ফেব্রুয়ারি, মাত্র ২৭ বছর বয়সে, নিজেই পরলোকে চলে গিয়েছিলেন মাত্র ক’দিনের রোগভোগে৷ রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা উমাদেবীর মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, পড়ে ছিল শুধু প্রেতচক্রের খাতাগুলো। যেখান থেকে সামান্য কিছু কথোপকথন রবীন্দ্র-গবেষক অমিতাভ চৌধুরী সর্বজনসক্ষে তুলে ধরেন ১৯৭৩ সালে৷ বইটি আজও সুপারহিট৷