তার বাণীতে জীবন, তিনি রবীন্দ্রনাথই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন
কলকাতা টাইমস :
মৃত্যুকে তিনি বরাবরই দেখেছেন এক অন্য দৃষ্টিতে৷ জীবনে বহুবার প্রিয়জন বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন৷ মায়ের মৃত্যু যখন হয়েছিল তখন তার বয়স অল্প৷ সে বিচ্ছেদের শোক ভুলিয়ে দিয়েছিলেন নতুন বৌঠান (বৌদি) কাদম্বরী দেবী৷ কিন্তু কবির চব্বিশবছর বয়সে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা, মৃত্যু সম্বন্ধে কবির মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে গিয়েছিল৷ এবং, এই মৃত্যুকেই কবির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা বলে মনে করেন জগদীশ ভট্টাচার্যের মতো গুণীজন৷ এরপর স্ত্রী-বিয়োগ, কন্যার মৃত্যু, প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথের চলে যাওয়া থেকে রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবন জুড়ে যেন প্রিয়জনের মৃত্যুমিছিল৷
তা সত্ত্বেও কবি মৃত্যুশোককে কখনওই জীবনের আনন্দের উপর জায়গা দেননি৷ কারণ তার উপনিষদের শিক্ষা৷ সমস্তটার মধ্যেই যে সব আছে, পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে যে পূর্ণই থেকে যায় এ তিনি প্রকৃতিস্থ করেছিলেন সেই বালকবয়সেই৷ ‘সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণপূরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনওখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না, একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না’- এ কথা ‘আশ্চর্য নতুন সত্যে’র মতো উপলব্ধি করেছিলেন তিনি৷
কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনকে দেখাও কবি অন্তত একবার জীবনে আত্মহননের কথা ভেবেছিলেন৷ সে সময়টা গ্রীষ্মের সময় কবি রামগড়ে বাস করছেন(১৯১৪)৷ কবির মন বেশ প্রসন্ন৷ এক মালির ছেলের কাঁপুনি রোগ ছিল৷ কবি নিজে তাকে ওষুধ দিলেন৷ রোগ সেরেও গেল৷ কবির ডাক্তার হিসেবেও নাম ছড়িয়ে পড়ল৷ এ সময়ই হঠাৎ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন কবি৷ বিশ্বের পরিস্থিতি হোক, কিংবা অন্তর্দ্বন্দ্ব, কবির মন যেন বিষাদের ঘন মেঘে ঢাকা৷ এর কিছুদিন পরই বাধবে প্রথম মহাযুদ্ধ৷ বিশ্বের এই পরিস্থিতিতে কবি আঘাত পেয়েছিলেন৷
প্রার্থনা করেছিলেন এই ‘বিশ্বপাপ’কে দূর করার৷ এদিকে এই সময় তার সাহিত্যও নতুন বাঁক নিয়েছে৷ লেখা হয়ে গিয়েছে স্ত্রীর পত্রর মতো গল্প৷ চতুরঙ্গ, ঘরে বাইরে-র মতো লেখার জন্য কবিকে ‘অনেক নামজাদা লেখকের কাছ থেকে অনেক রূঢ় বাক্য শুনতে হয়েছিল৷’ এর মধ্যেই আবার ব্যক্তিগত বিপর্যয়৷ আগে সুরুলে প্রায় বিশ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়ি ও জমি কিনে শিলাইদহের পাট চুকিয়ে চলে এসেছিলেন৷ কিন্তু ম্যালেরিয়ার জন্য সে স্থান ছাড়তে হল৷ সুরুলের স্বপ্ন অধরা থেকে গেল৷ গ্রাম সংস্কার থেকে কৃষিকার্যে গবেষণা ইত্যাদির যে পরিকল্পনা ছিল তা সব ‘আকাশকুসুম’ বলে মনে হতে থাকল কবির৷
এই পর্বেই, অর্থাৎ রামগড় থেকে ফেরার পর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে ‘মরবার ইচ্ছা’ কীভাবে তার মনকে গ্রাস করেছিল সে কথা জানান কবি৷ নিজেকে ‘আগাগোড়া ব্যর্থ’ মনে হয়েছিল তার৷ জানিয়েছিলেন, ‘নিজের উপর এবং সংসারের উপর আমার গভীর অশ্রদ্ধা ঘনিয়ে আসছিল৷’ নিজের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি বলেই ব্যথিত ছিলেন কবি৷ সম্ভবত কর্মজীবনের এই ব্যর্থতা তাকে গ্রাস করেছিল৷ আর তাই আত্মহননের কথাও ভেবেছিলেন৷ সে সময় কবি নোবেল পেয়েছেন, সারা বিশ্বে তিনি সম্মানিত৷ মাতৃবিয়োগ, নতুন বৌঠানের চলে যাওয়া, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মৃত্যুও যাকে টলাতে পারেনি, কর্মজীবনের ব্যর্থতাই সম্ভবত তাঁকে তাঁর ধ্যান থেকে সরিয়ে দিয়েছিল৷
জীবনে বহু শোক পেয়েছেন৷ কিন্তু শোককে কখনও জীবনের উপর জায়গা দেননি৷ মৃত্যু, শোক দহনের পরেও যে অনন্ত জাগে তারই সন্ধান করেছেন কবি৷ আমৃত্যু বিশ্বাস রেখেছেন তাতে৷ তবু সে সবেরই মাঝে এ যেন অচেনা এক রবীন্দ্রনাথ৷ এবং এখানেও তিনি পথপ্রদর্শকই৷ নিদারুণ এই হতাশা অতিক্রম করেও কী করে যে জীবনে আদর্শের সাফল্যে পৌঁছানো যায়, তাও দেখিয়েছিলেন তিনিই৷