‘সে ও জানতো ফিনিক্স পাখিকেও একদিন অগ্নিদগ্দ্ধ হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়তে হবে’
আবার চম্বল কাহিনী, এবার মিশন ‘ফুলন’ !!! (শেষ পর্ব )
সৌগত রায় বর্মন
তারপর নানা কাজে মনে দৈনিক অ্যাসাইনমেন্টের বোঝা বইতে বইতে দিন কাটতে লাগল। ফুলন নামের এক ফিনিক্স পাখির নাম কখনো মনে আসে আবার হারিয়েও যায়। কিন্তু ফুলনের ব্যাপারে আমাদের তথ্য সংগহ্ চলতেই থাকে।
সত্যিই চম্বল নদীর দু’পাশ এখন বিদ্রোহী বা বাগীশূন্য হয়ে পড়ছে। যাদের কথা এতক্ষণ ধরে আলোচনা হল তারা ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আগ্নেয়-প্রতীক। সংবিধান অনুযায়ী যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধী তারাই ডাকাত, দেশদ্রোহী, উগ্রপন্থী ইত্যাদি।
আমাদের অভিযান শুরু হয়েছিল মানসিং, নবাবসিংকে দিয়ে। শেষ হল জোয়ান অব অর্ক ফুলনকে দিয়ে। এই আলেখ্য কোনও উপন্যাস নয়। চম্বল থেকে সরাসরি ধারাভাষ্য। মাঝে কেটে গেছে দীর্ঘ সময়৷ পালটে গেছে চম্বলের বেহড়, বুন্দেলখণ্ডের জঙ্গল, ও মানুষগুলোও। কতদিন আর রক্তে প্রতিহিংসা পুষে রাখা যায়! আরও একটা প্রশ্ন মাথায় আসে, সংবিধান স্বীকৃত ডাকাতরা দখল করে নিয়েছে অসংবিধানিক রবিন হুডদের প্রতিষ্ঠান।
মালখান সিং-এর বয়স এখন ৭৬। কিছুদিন আগেই বলেছিল, “আমরা ডাকাতি করেছি ঠিকই কিন্ত কোনও গরীবের ভাত মারিনি, জোতদার, জমিদারদের আকণ্ঠ দৌলত আমরা লুট করে বিলিয়ে দিয়েছিলাম গরীব-গুর্বো চাষিদের মধ্যে। মাঝখানে ভেবেছিলাম রাজনীতি করব। কোনও দল আমাকে স্থান দিল না। কারণ আমি নাকি ডাকাত ছিলাম। হ্যাঁ ছিলাম, তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু যাদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না, দেশ তো দূরস্থান, তাদের ধনদৌতলের হিসাব কি আমরা রাখি?”
এশিয়ান গেমস রানার পানসিংকে তোমরা ডাকাত হতে বাধ্য করেছিল। সে পুলিশের গুলিতে মারা যায় ১৯৮১ সালে। তার ভতিজা বলবন্ত সিং-এর গলায়ও একই কথা। সে জানালো, “এ দেশে গরীবের জন্য কোনও আইন নেই, যা আছে সব বড়লোক আর উচ্চবর্ণের লোকজনের জন্য। কৃষক না খেতে পেয়ে মরলে খুনিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদেশে কোনও নেতা না খেয়ে নিহত হয় না। ভারতের প্রত্যেক নেতার বাড়িতে বোধহয় টাকা ছাপানোর মেশিন আছে। নইলে তাদের কাছে এত বস্তাভরা টাকা কীকরে থাকে?” সে আরও জানালো, “যে গ্রামের মাণ্ডি বা বাজারগুলি নিয়ন্ত্রণ করে এই রাজনৈতিক ডাকাতরাই। কোন জিনিসের দাম বাড়বে আর কমবে তা নির্ভর করে নেতাদের উপর, কৃষকদের উপরে না।”
এই মুহূর্তে শান্তি যেন লগ্ন হয়ে আছে চম্বলের মাটিতে। রবিন হুডের দল ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। ময়ূর নাচেনা বুলেটের শব্দে। কেনই বা নাচবে? ময়ূর নাচানোর বন্দুক ছিল যাদের হাতে সেই বন্দুক ডাকাতি হয়ে গেছে একদল অসভ্য, বর্বর ভণ্ড-দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক ডাকাতদের হাতে। বেহরের রুক্ষ জীবনে থেকে কতটুকু আর ডাকাতি করা যায়! উচ্চবর্ণের জোতদার জমিদাররা আজ ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত। নিঃশব্দে ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা, যার জন্য দায়ী চম্বলের ডাকাতরা নয়। রাজনৈতিক ডাকাতরা।
এখন যারা ডাকাতি করে তারা কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারা মাথায় ফেট্টি বেঁধে উটের পিঠে চড়ে না, কাঁধে রাইফেল নিয়ে চলে না, ধুতি পরে না। মাথায় ফেট্টি, কোমরে পিস্তল, হাতে দলীয় ঝাণ্ডা- তারাই আজ চম্বলের ডাকাত, বাগী নয়।