November 22, 2024     Select Language
Editor Choice Bengali KT Popular ওপার বাংলা সফর

যেখানে অপেক্ষা করছে নীল জলরাশির অপার বিস্ময়ে 

[kodex_post_like_buttons]
কলকাতা টাইমস :
ভ্রমণের জন্য আমার আগ্রহের তালিকায় উপরেই থাকে পাহাড় আর সমুদ্র। কারণ তাদের বিশালতার কাছে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়। এই ক্ষুদ্র মনে হওয়াটাই নিজের মনের কোণে জমে থাকা আত্মগরিমাকে এক ঝটকায় উড়িয়ে দেয়। ভ্রমণ অনেকের কাছে সেলফি আর স্লো মোশন ভিডিওগ্রাফির উপলক্ষ্য হলেও আমার কাছে ভ্রমণ মানেই আত্মশুদ্ধির এক অনন্য প্রেসক্রিপশন।
সেই প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করেই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে যাওয়া হয় সেন্টমার্টিন। ঢাকা থেকে টেকনাফ, সেখান থেকে পারিজাত জাহাজে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা। শুরুতেই ঝাঁকবেঁধে অসংখ্য গাঙচিলের অভিবাদন। প্রতিটি জাহাজকে ওরা এমনিভাবে পিছু নিতে থাকে পর্যটকদের দেওয়া খাবারের আশায়। চিপস, বিস্কুট- যে যা-ই দিচ্ছে, মুখে পুড়ে নিচ্ছে পরম বিশ্বস্ততায়। এই আচরণ সরলতা এক বিমূর্ত প্রতিমা স্বরূপ।
সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম সেন্টমার্টিন। জাহাজ ঘাটে ভিড়তেই কে আগে নামবে তার এক অযাচিত প্রতিযোগিতা। সেই সাথে স্থানীয়দের মধ্যে জেগে ওঠে কর্মচাঞ্চল্য। কেউ পর্যটকদের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত, কেউ আবার হোটেল বুকিংয়ের আকর্ষণীয় মূল্যহ্রাসের তথ্য দিতে ব্যস্ত।
সমুদ্র শুধু বিশাল জলরাশি নয়, তার মধ্যে সম্মোহন করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। প্রকৃতির নিয়ম মেনে প্রতিটি ঢেউ যেন নিজের স্বকীয়তায় অনন্য। কিছু ঢেউ পরম মমতায় সমুদ্রতটে দিয়ে যাচ্ছে ঝিনুক। আবার কিছু ঢেউ প্লাস্টিক বর্জ্য ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের হীন মানসিকতার জানান দিচ্ছে। নীল জলরাশির নুড়িপাথরে আছড়ে পড়ে যখন নিজেকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়; সেই আর্দ্রতা হৃদয়কে শীতল করে দেয় নিমিষেই। বিশাল সমুদ্র মাঝে মাঝে আলতো করে যখন পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়; তখন শুধু মনে হয় সমুদ্র বিশাল হয়েও কত নিরহংকারী!
মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্টমার্টিন গাণিতিকভাবে ছোট মনে হলেও এর বৈচিত্র্যের কারণে একে বিশাল মনে হবে। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত Sea weeds বা অ্যালগি একধরনের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্টমার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। অমেরুদণ্ডী প্রাণিদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্ন্যাসী শিল কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল, রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ, উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি।
শীতকালে দিনের আলো খুব কৃপণ থাকে। শেষ বিকেলে হঠাৎ করেই সন্ধ্যা নামিয়ে দেয়। নীল আকাশ, নীল জলরাশির সাথে মিলেমিশে একাকার, সাথে রক্তিম সূর্য–যেন এক পরাবাস্তব সৌন্দর্যের মঞ্চায়ন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই হাজার তারার মেলা। আকাশের তারা গোনা না-কি একইসাথে অসম্ভব আর বোকা একটি কাজ। আশ্বস্ত করছি, সেন্টমার্টিনের এ পরিবেশে বাকি জীবনটা যদি তারা গুনে চলে যেত, তাহলে যাপিত জীবন নিয়ে একটুও আফসোস থাকতো না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে জীবন, বাকিটা সময় শুধু মৃত্যুর আয়োজন।
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটার পর নিজের মনের ও মাংসপেশীর একটুও অভিযোগ নেই। ৫-১০ মিনিট হাঁটার দূরত্বে রিকশার বায়না করা আমার স্ত্রীও হাঁটছেন ক্লান্তিহীন। নুতন জায়গায় প্রত্যেক খাবারের স্বাদ নেওয়ার লোভ আমার সব সময় কাজ করে। কারণ একটাই, যদি আর আসা না হয়! আমাদের সবার জীবনেই এমন জায়গা আছে; যেখানে আমাদের প্রথম ও শেষবার যাওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বাজারে পর্যটকদের অভিজাত শ্রেণিতে গণ্য করা হয়। ৫ টাকার চা ২০ টাকায় খেতে একটু বিরক্ত লাগবে, তবে সবচেয়ে মুখরোচক হল ‘মাছ ভাজা’। রূপচাঁদা, ফ্লাইং ফিশের স্বাদ অসাধারণ। কোরাল মাছের বারবিকিউ সবচেয়ে তৃপ্তিকর খাবারের মধ্যে উপরের দিকেই থাকবে। আমার মনে হয়, প্রতিটি সামুদ্রিক মাছের স্বাদ বিভিন্ন, কিন্তু সুস্বাদু।
এরপরেই ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা। ছেঁড়া দ্বীপে যেতে চাইলে সাইকেল বা বাইক, স্পিড বোট আর ট্রলার আছে। শীতকালে সাগর শান্ত থাকায় তিনটি মাধ্যমই নিরাপদ। প্রায় দেড় ঘণ্টায় পৌঁছন যায় ছেঁড়াদ্বীপে।
ছেঁড়া দ্বীপের জল আরও বেশি নীল। মনে হবে পৃথিবীর সব নীল রং ধার করে নিজেকে সাজিয়েছে ছেঁড়া দ্বীপ। পানি এতই স্বচ্ছ যে, ৫-৬ ফুট নিচের শৈবাল, মাছ পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল। মনে হবে, বড় কোনো অ্যাকুরিয়ামের মাঝে ট্রলার নোঙর করা আছে। দ্বীপে নেমেই পরিবেশ অধিদফতরের সাইন বোর্ডে কিছু নীতিমালা চোখে পড়বে। দ্বীপের একটু ভেতরে যেতেই চোখে পড়বে প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, তারামাছ, কাছিম, রাজ কাঁকড়া, সামুদ্রিক ঘাস, শৈবাল এবং কেয়া ফল।
ছেঁড়া দ্বীপ যদি কোনো রাজত্ব হয়, তাহলে সেই রাজত্বের রাজা লাল কাঁকড়া, ঝিনুক আর শামুক। ছয় পা নিয়ে রাজকীয় চালে হেঁটে চলছে লাল কাঁকড়া, নরম মাটিতে এঁকে দিচ্ছে পদচিহ্ন। বাহারি রঙের ঝিনুক আর শামুক দেখে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্লোভ মানুষটিরও পকেটে পুড়ে নেওয়ার লোভ হবে। তবে শীতকাল হলেও দিনের এ সময় সূর্যের বেশ দাপট। তাই জলতৃষ্ণা নিবারণে আছে ডাব, জল সুমিষ্ট; কিন্তু ‘পর্যটক’ কোটায় প্রতিটির মূল্য ৬০-৭০ টাকা!
সাগরের ঢেউয়ের শব্দ এত মোহাবিষ্ট করতে পারে ছেঁড়া দ্বীপে না এলে জানা হতো না। মনে হবে, কারো এক অদৃশ্য নির্দেশে সাগরের ঢেউ বিরামহীনভাবে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রতটে। এই অনুভূতিগুলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজের বিশ্বাসকে আরও প্রগাঢ় করে। শুরুতেই আত্মশুদ্ধির যেই প্রেসক্রিপশনের কথা বলেছিলাম, এসেই প্রেসক্রিপশনের পূর্ণতা পাওয়া গেল ছেঁড়া দ্বীপে। সময়ের সীমাবদ্ধতায় ঘণ্টা দুই পর ছেঁড়া দ্বীপ থেকে বিদায় নিলাম। সেন্টমার্টিনে ফিরে বিশ্রাম, দুপুরের খাবার শেষ করে বিকেলে জাহাজে আবার টেকনাফের উদ্দেশে যাত্রা। ফিরতি পথে আবারো সেই গাঙচিলের আগমন। কিন্তু এবার স্বাগত নয়, বিদায় সম্ভাষণ।

Related Posts

Leave a Reply