পাত কুয়ো কাটাবে গো, পাতকুয়ো?
ভাবুক বাবুর ভাবনা
“পাতকুয়ো কাটাবে গো, পাতকুয়ো”- না, এই ডাক আর শোনা যায় না। বছর চল্লিশ আগেও তাদের দেখা যেত। কোমরে দড়ি, হাতে কোদাল, বেলচা। আজ আর তারা নেই।
তা, কত কিছুই তো নেই। সিনেমাহলে ব্ল্যাকার নেই, পাড়ায় পাড়ায় ফোন বুথ নেই, নিঝুম দুপুরে “শিল কাটাও” নেই। পাতকুয়ো কাকে বলে সেটাই সম্ভবত এ যুগের ছেলেমেয়েরা জানে না। নতুনগ্রামে বাড়ি বাড়ি কলের জল আসার পর কুয়ো বস্তুটা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। এখন পুকুরই তো হাতে গোনা, কুয়ো তো কোন ছাড়।
পাতকুয়োর কথা উঠলেই একটা করুণ গল্প মনে পড়ে যায়। গল্পটা ঠিক নতুনগ্রামের নয়, তবে নতুনগ্রামেরও হতে পারত, কেননা এই জনপদে অনেক কিছুর অভাব হয়ত ছিল, কিন্তু পাগলের অভাব ছিল না। প্রায় পরমবীর চক্র পাওয়া পাগল ছিল সন্তোষ। শোনা যায়, তার রসনা তৃপ্ত করতে মিষ্টির দোকানের স্পেশাল সাইজের রসগোল্লা যখন ফেল পড়ে গেল, তখন নাকি কে কে স্টিলকে ফুটবলের সাইজের রসগোল্লা বানানোর বরাত দেওয়া হল। কারখানার তরফ থেকে নাকি শুধু একটাই শর্ত দেওয়া হয়েছিল- স্টিলের মোড়ক ভেঙে রসগোল্লার স্বাদ নিতে হবে। শুনেছি, সেই রসগোল্লা ভাঙতে না পেরে বড় দুঃখে সন্তোষ বৈতরণী পার হয়ে এখন স্বর্গে কামধেনুর দুধ পচিয়ে ছানা খাচ্ছে।
সন্তোষ ছিল নিরাপদ পাগল। কিন্তু সবাই তো আর সন্তোষ নয়। কেউ কেউ খুব বিপজ্জনক ছিল। যদি কারো পাতকুয়ো কাটানোর দরকার পড়ত তবে কুয়ো কাটানোর লোকের বাপ ঠাকুদ্দা তো বটেই, চোদ্দ পুরুষের কেউ কখনো পাগল ছিল কিনা খোঁজ নিতে হত। সে কথায় পরে আসছি।
নিধিরবাবু বাড়ির সামনে পিছনে পাঁচিল দেননি, লাইন দিয়ে পাতকুয়ো কাটিয়ে রেখেছিলেন। না, না, শুদ্ধ জল খাবেন বলে নয়, কুয়োগুলি ছিল মরণফাঁদ। কুয়োর উপরে থাকত লতাপাতা আর মাধবীলতার ঝাড়। যদি বাড়িতে ডাকাত পড়ে, তবে ঝোপঝাড় ভেঙ্গে ব্যাটারা সোজা কুয়োয় পড়ে সলিল সমাধি হবে- এই ছিল মনোবাসনা। নিধিরবাবু নিজেদের খাওয়ার জলের কুয়ো কাটিয়েছিলেন রান্নাঘরে যাতে কেউ জল চুরি করতে না পারে।
সুচিবুড়ি নামের এক পাগলী ছিলেন, তিনি প্রকৃত অর্থেই কুয়োপ্রেমী। মাঝরাত থেকে সারাদিন বালতি করে জল তুলতেন আর পা ধুতেন। দিবারাত্রি অনবরত কেউ যদি একটা কুয়ো থেকে জল তোলে তবে যা হওয়ার তাই হল। আশেপাশের কুয়োগুলিও গেল শুকিয়ে। তখনো নতুনগ্রামে কলের জল আসেনি, কুয়োর জলই একমাত্র ভরসা। সেই কুয়োয় যদি জল না থাকে তো পাড়া প্রতিবেশীর চলে কি করে? কিন্তু বুড়িকে বোঝাবে কে? তার সাফ কথা- আমার পায়ে যদি নোংরা থাকে তবে তা ধোবে কে? কুয়ো আমার, জল আমার, পা আমার। তা নিয়ে আমি যা খুশি তাই করব- তাতে কার বাপের কি? হক কথা। এ নিয়ে থানা পুলিশও করা যায় না। সবাই পরিচিত। বলা যায় আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই তখন নতুনগ্রামের ব্যাপ্তি। ইতিমধ্যে যে কোন কারণেই হোক, এই অঞ্চলে পাগলের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই পাগল সেজে ঘুরে বেড়াত। কারণ পাগলদের লোকে এক ডাকে চিনত। পাগলের জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও জজ, উকিল, ডাক্তাররা আসতে পারত না। বিভিন্ন পাগলকে নিয়ে সে কী মজা- পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে!
অবশ্য ওদের নিয়ে হ্যাপাও কিছু কম ছিল না। কুয়োর প্রতি পাগলদের ছিল একটা অদম্য টান। শোনা যায় ওদের মধ্যে কেউ কেউ জাল নিয়ে কুয়োয় নেমে যেত মাছ ধরবে বলে। কেউ আবার কুয়োর পাড়ে পা ঝুলিয়ে লম্বা সুতোর ছিপ ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকত বোয়াল মাছের আশায়। গ্রীষ্মের চাঁদি ফাটা গরমে বহু পাগল কুয়োয় ঝাঁপ দিত মাথা ঠান্ডা করবে বলে। কেউ ঊঠত, কেউ আর উঠত না।
নিরঞ্জনবাবু বাড়িতে কুয়ো কাটাবেন। এক ডাকাবুকো চেহারার লোক এসে হাজির। নিরঞ্জনবাবু জিজ্ঞেস করলেন- কতজন লোক লাগবে হে? আমি কিন্তু খুব বেশি মজুরের পয়সা দিতে পারব না। লোকটা এক গাল হেসে বলল, হুজুরের দয়ায় শরীলখান দ্যাখসেন তো। লুকজন আমার লাগে না। আমি একাই কুয়া কাটি। গুরুর বিদ্যা কাউরে শিখাইতে নাই। নিরঞ্জনবাবু খুব খুশি। বললেন-তাহলে আজ থেকেই লেগে পড়। কদ্দিন লাগবে? লোকটা বলল- আইজ সারা দিন সারাডা রাইত কাম করলে কালই হইয়া যাইব। রাতে দুইখান হ্যারিকেন লাগব। বাবু রাজি। শুরু হল কুয়ো কাটা।
পরদিন ভোর। নিরঞ্জনবাবু সকালে উঠে দেখলেন, লোকটা একমনে কুয়ো কাটছে। জিজ্ঞেস করলেন- কি হে, কাজ শেষ হল? লোকটা একগাল হেসে বলতে শুরু করল- চার চার চার। বাবু অবাক হয়ে বললেন- কি চার চার করছ? কুয়ো কাটা কেমন হল? লোকটা বলল- চমৎকার হইসে, এক্কেরে টলটলে জল। সামনে আইস্যা দ্যাখেন, খুব মজা পাইবেন। তারপর আবার বলতে লাগল – চার চার চার। বাবু রেগে গিয়ে বললেন- আবার চার চার? দেখি কেমন কাটলে? বাবু ঝুঁকে দেখতে যেতেই লোকটা এক ধাক্কা মেরে নিরঞ্জনবাবুকে কুয়োয় ফেলে দিয়ে বলতে লাগল – পাঁচ পাঁচ পাঁচ। তার অল্প পরেই নতুনগ্রামে জলের ট্যাঙ্ক হল, কলের জল এল। তার পর থেকে কুয়ো কাটানোর লোকের চোদ্দ পুরুষের কেউ কখনো পাগল ছিল কিনা খোঁজ নিয়ে তবেই লোকে কুয়ো কাটাতো।
দয়ালু পাঠাক, দয়া করে এই গল্পের মধ্যে আবার রাজনীতি খুঁজতে যাবেন না। জানি, যেভাবে আজও, একই ভাবে চোর, চোট্টা, সেলিব্রিটি , অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অন্ধ্য কুয়োয়, ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হল, তা এই গল্পেরই আধুনিক সংস্করণ। সেলিবদের ফুটুর ডুম। তাই স্বধর্মে নিধন শ্রেয়, পরধর্ম ভয়ংকরম, কথাটা এক্ষেত্রে তাদের মনে রাখা তাদের উচিৎ ছিল।