পান
[kodex_post_like_buttons]

অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
লক্ষীপুজোর সকাল। প্রতীক জাম্বো বিছানায় গড়াচ্ছিল। অনেকটা হঠাত্ আসা বাদলা মেঘের মত এদিকওদিক আলসেমি জড়ানো প্যাচানো। অসহ্য ঘ্যানঘেনে ক্লান্তি আর মনখারাপের ভার তার মগজে।
মার ঘরের ভেজানো দরজা ছাপিয়ে রোগীর বিছানা থেকে মাঝে মাঝেই মা’র গলা কানে আসছিল-
“ও প্রতি,বাজারে যা বাবা এক গোছ পান নিয়ে আয়। সব আনলি পানটাই ভুলে গেছিস যে। পান ছাড়া পুজো হয়? তোর বাবার নিজেরইতো দশ বিশটা পান লাগে দিনে। ভাত না খেলেও তার চলবে, পান না খেয়ে পারবে? পেট ফুলে মরে যাবে যে লোকটা! “একে পক্ষাঘাত তারওপর স্মৃতিভ্রংশ। দু-বছর ধরে একটানা শুয়ে থেকে থেকে আটকে আছেন সেই লক্ষীপুজোয়! বিপাশার মগজে রোজই লক্ষী পুজো! রোজই পানের ফরমাশ।
প্রতীকের বাবা অমরেশ তখন বেঁচে।স্কুলের চাকরী থেকে অবসর নেবার মাস ছয় তখনো বাকী।প্রতীক পড়া শেষ করে বড় চাকরীতে ঢুকেছে।বিদেশে।সুদিনের নাগালে বিপাশার আহ্লাদ তখন ছলকে ছলকে উঠছে।
বাড়ি সারাই করবেন, বড় করবেন, প্রতীকের বিয়ে দেবেন,নাতি পুতি নিয়ে আহ্লাদে দিন কাটাবেন।
অমরেশ পান চেবান আর চোখ বুজে বিপাশার স্বপ্ন বুনোট করা বকর বকর শোনেন। ছেলেমানুষীতে হাসেন।
সেদিনও ছিল লক্ষ্মীপুজো।বিপাশার দম ফেলার সময় ছিলনা। বিয়ে করে প্রতীক বিদেশী বৌ নিয়ে দেশে ফিরেছে সবে দু-দিন ।বিপাশার নতুন বাড়িময় লোকজন আত্মীয়তে ছয়লাপ।সকলেই ব্যস্ত নতুন বউকে দেশীয় রীতি আচারের সাথে পরিচিত করাতে।মুখে মুখে মারিয়াও দেশী নাম পেয়ে হয়েছে মীরা।
তার হাজার কাজের মধ্যে দুপুরে বিপাশা অমরেশের হাতে পানের বাটা তুলে দিয়ে পইপই করে বলেছিলেন পান মুখে না শুতে। সেই বিপাশাই বউমার মুখ পানপাতায় মুছে বরন করবেন ভেবে পানবাটা খুঁজতে যেয়ে আবিষ্কার করেন অমরেশ বিছানায় গোঙ্গাচ্ছেন, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাসপাতালে নিতেনিতেই শেষ।
ডাক্তারের বক্তব্য, পান সুপুরি শ্বাসনালীতে ঢুকেই এই বিপত্তি।আর তার পরেপরেই,বিপাশার স্ট্রোক,পক্ষাঘাত সব যেন হুড়মুড়িয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বিপাশার স্বপ্নগুলোকে ছেঁড়া পুতির মালা বানিয়ে ছাড়লো।
প্রতীক দেখল উত্সব আনন্দে যারা ভিড় করে এসেছিল, সংকটে সবাই ভোঁ-ভা।
পরের সুখ কার বা সয়,পরের দুখ কেই বা বয়? আত্মীয়রা সকলে সরে গেল যে যার কাজ দেখিয়ে।সংসার অনভিজ্ঞ প্রতীক অথৈ জলে। হাবুডুবু শুধু না, একেবারে নাকানিচোবানি দশা।
প্রতীকের বিদেশী বউও মাসতিনেক এদেশ থেকে নিজের দেশে ফিরেগেল।ফিরতে পারলো না প্রতীক ।
মার কথা ভেবেই ফেরা হল না।অসুস্থ মা’র পাশে তাকে থেকে যেতেই হল। সে ছাড়া আর আছেইবা কে যে থাকবে? রাখবেইবা কার কাছে? বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল কেউ এমন রুগীতে রাজি হয় নি। পরিজনতো দূরস্ত।
দুবছর ধরে প্রতীক একটা হেস্তনেস্ত চাইছে, কিন্তু হচ্ছে কই? মাঝে মাঝেই বালিশ চাপার কথাটাও মনে আসে।ছিঃ।
এদিকে কোম্পানি সমানে তাগাদা দিচ্ছে হয় এসো নয় ছাড়। বিদেশী বউও পরিস্কার জানিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে না ফিরলে সেও অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। তবে হ্যা,বিদেশী বউ প্রতীককে ফেরত যাবার সময় সাথে করে এক দু গ্রোস পান নিয়ে যেতে বলেছে।
পানপাতার ওই হার্ট শেপটা তার খুব পছন্দ হয়েছে! যেন লাভ্ সাইন!